ফিরহাদের সঙ্গে তুলনা চলছে দুলালের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
তিনি বিধায়ক এবং মন্ত্রী। অতএব, দলের ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি মেনে তাঁর কলকাতা পুরভোটে টিকিট পাওয়ারই কথা ছিল না। কিন্তু তিনি টিকিট পেয়েছেন। মন্ত্রী থেকেছেন। পুরভোটে জিতে মেয়রও হয়েছেন।
তিনি বিধায়ক। অতএব, দলের ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি মেনে তাঁরও পুরভোটে টিকিট পাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তিনিও টিকিট পেয়েছেন। পুরভোটে জিতে পুরসভার চেয়ারম্যানও হয়েছেন।
প্রথমজন— ফিরহাদ (ববি) হাকিম। কলকাতার মেয়র। রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী। যিনি সম্প্রতি নগরোন্নয়ন দফতরটিও ফিরে পেলেন। শাসক তৃণমূলের অন্দরের সমীকরণে যিনি দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম ‘আস্থাভাজন’ বলেই পরিচিত।
দ্বিতীয়— দুলাল দাস। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মহেশতলা পুরসভার চেয়ারম্যান। দুলাল ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের অন্তর্গত মহেশতলা বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়কও বটে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা তৃণমূলের অন্দরমহলের রাজনৈতিক সমীকরণে যিনি ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’ বলেই পরিচিত।
ফিরহাদ এবং দুলালের দৃষ্টান্ত পাশাপাশি রেখে তাই তৃণমূলের অন্দরে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে যে, দুলাল কি আসলে ফিরহাদের ‘জবাব’? যদিও এমন কিছু দলের নেতারা মানতে চাইছেন না। বস্তুত, তাঁদের বক্তব্য, দু’জনের ক্ষেত্রেই যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ‘অন্যকিছু’ খোঁজা বৃথা। তাঁদের আরও দাবি, এসব বলে বিরোধীরা তৃণমূলের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি করতে চাইছে।
ঘটনাপ্রবাহ যা বলছে, বিধানসভা ভোটের পর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক চেয়েছিলেন দলে ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি কার্যকর করতে। সেই মতো বিভিন্ন জেলায় সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা সভাপতিদের রদবদলও করা হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়ারই পরবর্তী ধাপ ছিল কলকাতা-সহ বিভিন্ন পুরভোটে প্রার্থিতালিকায় বিধায়ক, সাংসদ বা কাউন্সিলরের মতো বিভিন্ন পদাধিকারীকে যে কোনও একটি বেছে নিতে হবে। প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা ‘আইপ্যাক’-এর সঙ্গে সমঝোতা অনুসারে ঠিক হয়েছিল, কলকাতা পুরভোটে পাঁচ বিধায়ককে টিকিট দেওয়া হবে না। সেই তালিকায় প্রথম নামটি ছিল ফিরহাদের। কারণ, তিনি একাধারে মেয়র এবং মন্ত্রী। অসমর্থিত সূত্রের খবর, ফিরহাদ দলকে জানিয়েছিলেন, তিনি প্রয়োজনে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি। কিন্তু পুরভোটে লড়তে চান (অর্থাৎ, মেয়র হতে চান)। কিন্তু দল তাঁকে মন্ত্রিত্ব রাখতে বলেছিল।
সেই টানাপড়েন প্রার্থিতালিকা ঘোষণার দিন চরমে পৌঁছয়। শেষে দেখা যায়, মমতার ‘হস্তক্ষেপে’ ফিরহাদ-সহ পাঁচ বিধায়কই টিকিট পেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে টিকিট পেয়ে গিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মালা রায়ও। যিনি কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তখন থেকেই তৃণমূলের অন্দরে একটা ‘বিভাজন’ তৈরি হয়েছিল। কারণ, ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতিকে ‘অগ্রাহ্য’ করেই মন্ত্রী ফিরহাদ ভোটে জেতার পর মেয়র পদেও প্রত্যাবর্তন করেন।
এর পরেই আসে রাজ্যের ১০৮টি পুরসভার ভোট। সেই প্রার্থিতালিকা নিয়েও যথেষ্ট টানাপড়েন শুরু হয়। বস্তুত, কলকাতা-সহ পাঁচটি পুরনিগমের প্রার্থিতালিকা নিয়েও অতটা টানাপড়েন দেখা যায়নি। তৃণমূলের অন্দরের চাপানউতর প্রকাশ্যে এসে পড়ে। প্রার্থিতালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, মহেশতলার বিধায়ক দুলালকে ওই পুরসভায় টিকিট দেওয়া হয়েছে। যদিও তাঁর ওয়ার্ডটি বদলে গিয়েছে।
মহেশতলার চারবারের কাউন্সিলর দুলাল ২০১৫ সাল থেকে পুরসভার চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রী কস্তুরী দাস ২০১১ থেকে মহেশতলার বিধায়ক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে উপনির্বাচনে মহেশতলা থেকে বিধায়ক হন দুলাল। সেই থেকেই তিনি যুগপৎ মহেশতলার বিধায়ক এবং চেয়ারম্যান। যেমন কলকাতায় ফিরহাদ।
পুরভোটে জেতার পর আবার বিধায়ক দুলালকেই পুরসভার চেয়ারম্যান করা হয়েছে। সেই সূত্রেই তৃণমূলের অন্দরে অনেকে মনে করছেন, দুলাল আসলে ফিরহাদের ‘পাল্টা’ উদাহরণ। প্রকাশ্যে অবশ্য কেউই তেমনকিছু বলছেন না। বলার কথাও নয়। কিন্তু তৃণমূলের সাম্প্রতিক অতীতের বিতর্কই ফিরহাদের সঙ্গে দুলালের তুলনা উস্কে দিয়েছে। দলের এক শীর্ষনেতার অবশ্য দাবি, ‘‘দু’জনেরই পুর প্রশাসন পরিচালনার অভিজ্ঞতা বিপুল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যখন রাজ্যের সর্বস্তরে উন্নয়নের যজ্ঞ শুরু হয়েছে, তখন তা কার্যকতর করার জন্য কিছু অভিজ্ঞ এবং দক্ষ প্রশাসকও প্রয়োজন। আবার একই সঙ্গে তাঁদের প্রয়োজন বিধানসভাতেও। সে কারণেই ববি-দুলাল দু’জনকেই বিধায়কের পাশাপাশি পুর প্রশাসনের মাথাতেও রাখা হয়েছে। এটা প্রয়োজনীয় ব্যতিক্রম বলেই ধরে নেওয়া উচিত।’’