মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় বলেন, ‘জঙ্গলমহল হাসছে।’ কিন্তু সেই হাসি অচিরেই মিলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।
সম্প্রতি বৈঠকে বসেছিল রাজ্যে সক্রিয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয় কমিটি। সেই বৈঠকে পেশ হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যে রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে, তার মূল কথাই হল— ‘পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হচ্ছে মাওবাদীরা। ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ার কয়েকটি স্থানে তারা প্রায় নিয়মিত আনাগোনা শুরু করেছে।’ রাজ্য পুলিশকে সতর্ক করে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের কাজকর্মে জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাঁদেরই একাংশ এখন মাওবাদীদের দিকে ঝুঁকছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, বর্ষায় জঙ্গল ঘন হয়ে উঠলেই মাওবাদীদের তৎপরতা বাড়তে পারে। যার জেরে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে জঙ্গলমহলের তিন জেলা বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুর।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘ছত্তীসগঢ়ের সুকমা অঞ্চলে পরপর কয়েকটি হামলায় মাওবাদীরা তাদের শক্তি জানান দিয়েছে। ঝাড়খণ্ড ও বিহারেও ফের হামলার ছক কষছে তারা। এর সঙ্গেই মাওবাদীরা নতুন করে ঘর গোছানো শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাদের লক্ষ্য, আগামী বছর ভোটের আগে জঙ্গলমহলে অশান্তি তৈরি করা।’’ ওই কর্তা জানান, জঙ্গলমহলের তিনটি জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্প্রতি যে সব পোস্টার মিলেছে, তার সব ক’টি একই হাতে লেখা। এবং পোস্টার লাগানোর দিন ক্ষণ বিচার করে মনে করা হচ্ছে, ঝাড়গ্রামের দিক থেকেই তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে ২৬/১১-র হামলার পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়, তথ্য আদান-প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘মাল্টি এজেন্সি সেন্টা’র বা ‘ম্যাক’। রাজ্য স্তরেও ম্যাকের নিয়মিত বৈঠক হয়। রাজ্যে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের তদারকি করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর যুগ্ম অধিকর্তা। তেমনই গত ৩ জুন কলকাতায় রাজ্যের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে সমস্ত নিরাপত্তা সংস্থার গোয়েন্দা কর্তারা বৈঠকে বসেছিলেন। তাতে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ, কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স, স্পেশ্যাল ব্যুরো (র), সেনা, বায়ুসেনা, নৌসেনা, এনআইএ, আধাসামরিক বাহিনী, রেলরক্ষী বাহিনী এবং রেলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি এজেন্সির তথ্য বিশ্লেষণ করে যে চূড়ান্ত রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে, তাতেই জঙ্গলমহলে ফের মাওবাদী সক্রিয়তার কথা স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে।
কী বলছে নবান্নে আসা ওই রিপোর্ট? তাতে বলা হয়েছে, ‘মাওবাদীরা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং জনগণের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে। পুরুলিয়ার কাশি জঙ্গল (কাশিডি) এলাকা, শালবনির বুড়িশোল এবং বলরামপুরের যুগিডি গ্রামে মাওবাদীরা যাতায়াত শুরু করেছে।’ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ‘ছত্রধর মাহাতো এবং আরও পাঁচ জনের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণার পরে জঙ্গলমহলে গত ২৫ মে ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছিল মাওবাদীরা। মনে করা হয়েছিল, বন্ধে তেমন সাড়া মিলবে না। কিন্তু জঙ্গলমহলের মাহাতো সম্প্রদায় সমর্থন করায় বন্ধ অনেকটাই সফল হয়েছে।’
ম্যাকের রিপোর্ট হাতে পেয়ে নবান্নের কর্তারা উদ্বিগ্ন। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ঝাড়গ্রাম সফরের আগেও মাওবাদীদের তৎপরতা টের পেয়েছিলেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী এবং তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী যে মাওবাদীদের খতম তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন, বিভিন্ন সূত্রে তা আগে থেকেই তাঁদের জানা। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, নতুন করে যে তিনটি জায়গায় মাওবাদীরা আনাগোনা শুরু করেছে, সেখানে ইতিমধ্যেই তাদের জোরালো সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে। পুরুলিয়ায় মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের শীর্ষ নেতা বিক্রম ওরফে অর্ণব দাম ধরা পড়ার পর থেকেই সেখানে মাওবাদীদের শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছিল। পরে সেখানকার প্রথম সারির বেশ কয়েক জন নেতাও আত্মসমর্পণ করেন। অবশ্য এখনও অধরা রঞ্জিত পাল, হলধর গড়াই, বীরেন, পার্বতী টুডু, রমেশ সিংহ এবং কামা সিংহের মত স্কোয়াড সদস্যেরা, যাঁরা ওই এলাকা হাতের তেলোর মতোই চেনেন।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েতের যুগিডি, কাশিডি, বুড়িডি-র মতো গ্রামগুলিতেই এখন আবার যাতায়াত শুরু করেছে মাওবাদীরা। মনে করা হচ্ছে, ওই অধরা নেতারাই এলাকায় ফের সংগঠন গড়ার চেষ্টা শুরু করেছেন। বাম জমানায় এই এলাকা মাওবাদীদের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, এখান থেকেই ২০১০ সালের লক্ষ্মীপুজোর সময় পুলিশ অফিসার পার্থ বিশ্বাস এবং স্কুলশিক্ষক সৌম্যজিৎ বসুকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল মাওবাদীরা। অন্য দিকে, শালবনির যে বুড়িশোল এলাকায় যৌথ বাহিনীর অপারেশনে নিহত হয়েছিলেন কিষেণজি, সেখানেও ফের মাওবাদীদের গতিবিধি ঠাওর করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা মনে করছেন, পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সরকার-বিরোধী ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে, সেটাই মাওবাদী তৎপরতার জমি তৈরি করে দিচ্ছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, লালগড়ের কাঁটাপাহাড়ি ও ধরমপুর, বেলপাহাড়ির বাঁশপাহাড়ি, শিমুলপাল ও ভুলাভেদার মতো পঞ্চায়েত এলাকায় শাসক দলের মধ্যে ব্যাপক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। পঞ্চায়েতের কাজকর্ম নিয়ে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জঙ্গলমহলে বিরোধী দলের লোকজনকে এখন (অনেকের মতে, বাম আমলের মতোই) রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করার অভিযোগ উঠছে। এই আবহে এলাকাবাসীর একাংশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। তারই সুযোগ নিচ্ছে মাওবাদীরা।
স্থানীয় সূত্রের খবর, গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বেলপাহাড়ির আমলাশোল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ঘাটশিলা থানার চেকাম জঙ্গলে মাওবাদী ও যৌথ বাহিনীর সংঘর্ষে এক কোবরা জওয়ান প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন কোবরা বাহিনীর এক ডেপুটি কম্যান্ডান্ট। গত বছর সেপ্টেম্বরে বেলপাহাড়ির বিভিন্ন এলাকায় মাওবাদীদের ব্যানার-পোস্টার পাওয়া যায়। ব্যানারগুলিতে মাওবাদীদের দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘পিপলস্ লিবারেশন গেরিলা আর্মি’ (পিএলজিএ) বা গণমুক্তি গেরিলা ফৌজকে ‘পিপলস্ লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ) বা গণমুক্তি ফৌজে পরিণত করার জন্য সদস্য-সংগ্রহ অভিযান চালানোর ডাক দেওয়া হয়।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে গত ২৭ মে সিআরপি-র ডিজি প্রকাশ মিশ্র লালগড়ে এসে তাঁর বাহিনীর ৫০ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সদর কার্যালয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছিলেন। এখন জঙ্গলমহলে প্রায় ৪০ কোম্পানি সিআরপি মোতায়েন রয়েছে। তবে আগের মতো তারা যৌথ অভিযান করছে না। কারণ, তা করতে গেলে রাজ্যকেও প্রায় ৪০০০ পুলিশ মোতায়েন করতে হবে, যা খরচসাপেক্ষ। তবে এখন ম্যাকের রিপোর্ট ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ফের জঙ্গলমহলে যৌথ অভিযান শুরু করা হবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে।
সহ প্রতিবেদন: কিংশুক গুপ্ত এবং প্রশান্ত পাল।