প্রতীকী ছবি।
দীর্ঘ প্রায় ছ’টি দশকের উদ্যোগ। কিন্তু নিছক উদ্যোগই! ছাপার অক্ষরেই সীমাবদ্ধ প্রশাসনিক নির্দেশ। সেই বেড়াজালেই আটকে প্রশাসনিক কাজে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার।
নির্দেশ থাকলেও প্রশাসনিক কাজে মাতৃভাষা ব্যবহার জনপ্রিয় হয়নি কেন? কারণ, বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিল না। যা নির্দেশিকার সঙ্গে সঙ্গেই করা উচিত ছিল বলেই মনে করেন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রাক্তন ও প্রবীণ কর্তারা। এক কর্তা বলছেন, ‘‘সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অভ্যাস নির্দেশিকা দেওয়ার সময় থেকেই বাধ্যতামূলক করা উচিত ছিল।’’ সেটা করা হলে এত দিনে সর্বস্তরের কর্মীদের কাছে ব্যাপারটা সড়গড় হয়ে যেত। তবে প্রকল্প-প্রচারের স্বার্থে আগের তুলনায় বাংলার ব্যবহার বিগত কয়েক বছরে কিছুটা হলেও বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন প্রশাসনের কর্তাদের অনেকে।
গত শতকের ষাটের দশক থেকে সরকারি কাজে বাংলার ভাষার নিবিড় ব্যবহারের কথা বলে আসছে রাজ্য সরকার। সত্তরের দশকে তৎকালীন সরকার লিখিত ভাবে নির্দেশ দেয়, সব ধরনের সরকারি আবেদনপত্র (ফর্ম) ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষায় ছাপতে হবে। নব্বইয়ের দশকে ফের একটি নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়, সাধারণের জন্য চিঠি, নির্দেশ, প্রচারপত্র, বিজ্ঞপ্তিতে তো বটেই, পঞ্চায়েতের সর্বস্তরে, স্বাস্থ্য এবং জনসাধারণের পরিষেবামূলক সব কাজে বাধ্যতামূলক ভাবে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। অবশ্য সেই নির্দেশিকার আওতার বাইরে ছিল দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পং। তবে সেই নির্দেশ যে মানা হয়নি, ২০০০ সালের নির্দেশিকায় লিখিত ভাবে সেটা স্বীকার করে নেওয়া হয়।
প্রশাসনিক উদ্যোগ
• ষাটের দশকে সরকারি কাজে বাংলার নিবিড় ব্যবহারে জোর।
• সত্তরের দশকে লিখিত ভাবে সেই নির্দেশ তৎকালীন সরকারের।
• নব্বইয়ের দশকে পরিষেবামূলক সব কাজে বাংলা বাধ্যতামূলক করা হয়।
• নির্দেশ মানা হয়নি, স্বীকার ২০০০ সালের নির্দেশিকায়।
• সরকারি কাজে বাংলা আবশ্যিক করে ২০০৪-এ নির্দেশ মুখ্যসচিবের।
১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে গোটা রাজ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করে ২০০৪ সালে ফের নির্দেশিকা দেয় রাজ্য সরকার। সেই নির্দেশিকায় তৎকালীন মুখ্যসচিব মণীশ গুপ্ত বলেছিলেন, সরকারি, আধা-সরকারি এবং স্বশাসিত সংস্থার কার্যালয়ে থাকা সাইনবোর্ড, নামফলক, লেটারহেড, ভিজিটিং কার্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আদেশনামা, বিজ্ঞপ্তি, হাসপাতালের বহির্বিভাগ, চিকিৎসার টিকিট, ফর্ম, থানার ডায়েরি, সরকারি বাসের টিকিট, জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্র— সব কিছুতে বাংলা আবশ্যিক করার কথা ছিল তাতে। বলা হয়, পঞ্চায়েত, গ্রামোন্নয়ন, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, পুর বিষয়ক, প্রাণিসম্পদ বিকাশ, জলসম্পদ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য ও সরবরাহ, পরিবহণের মতো দফতরের যে-সব কাজ সাধারণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, তার নির্দেশনামা, বিজ্ঞপ্তি, বাংলায় লিখতে হবে। ভিন্ন ভাষাভাষী সরকারি পদাধিকারীদের প্রশিক্ষণ ছাড়াও বাংলা আকাদেমির ‘বাংলা পরিভাষা সঙ্কলন— প্রশাসন’ এবং ‘বাংলা বানান রীতি’ দফতরগুলিতে সেই সময় রাখতে বলেছিল সরকার।
অনেক প্রশাসনিক কর্তা জানান, এখন মন্ত্রিসভার নথিতে (ক্যাবিনেট মেমো) ধারাবাহিক ভাবে বাংলা ব্যবহার করা হয়। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কিছু কাজে বাংলায় ‘নোট’ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে দফতরের কর্তাকেও বাংলাতেই সই করতে হয়। পুরসভা ও পঞ্চায়েতের কিছু কাজেও বাংলার ব্যবহার হচ্ছে। খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের ওয়েবসাইটে শহর ও গ্রাম সব অঞ্চলের রেশন কার্ডের জন্য আবেদনপত্র ইংরেজিতে। আবেদনপত্র পূরণের জন্য তো বটেই, তাতে কী লেখা আছে, তা জানতেও অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় অনেককে। রেশন কার্ডে অবশ্য বাংলা ও ইংরেজি, দু’টি ভাষাই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
রাজ্যের কেন্দ্রীয় এবং জেলা জেলে বন্দির সঙ্গে দেখা করার জন্য ই-মোলাকাতের যে-ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে আবেদন করতে হয় ইংরেজিতেই। সেটা বাংলায় করা গেলে বন্দির পরিজনদের সুবিধা হবে, মেনে নিচ্ছেন কারাকর্তারা। তাঁরা জানান, সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার ও পোর্টালটি ন্যাশনাল বা জাতীয় স্তরের। সেই জন্যই ইংরেজি। তবে রাজ্যের সরকারি বিজ্ঞাপনে বাংলা ব্যবহার করা হয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ হলেও সামগ্রিক ভাবে বাংলা ব্যবহারের সরকারি নির্দেশিকার প্রতি ‘অবহেলা’ ‘ঔদাসীন্য’ থেকেই যাচ্ছে বলে প্রশাসনের অনেকের পর্যবেক্ষণ। তাঁদের মতে, সব ক্ষেত্রেই নির্দেশ থাকে। তবে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সেগুলো পৌঁছনোর ক্ষেত্রে ব্যক্তির মানসিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে মানসিকতার পরিবর্তনটাও জরুরি।
অনেকের বক্তব্য, ইংরেজি বা হিন্দি তো এখন ‘স্টেটাস সিম্বল’! সেই সিম্বলকে বেশি সঙ্গী করলে বাংলা ভাষা একটু অনাদরে থেকে যাবেই।