মৌমিতা দাস। ছবি ফেসবুকের সৌজন্যে।
একে ‘জেঠু’তে রক্ষা নেই, ‘ভাইঝি’ দোসর!
রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমে একটি কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর তোড়জোড়ের সূত্রে শিরোনামে উঠে এসেছিল তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজির নাম। মাস কয়েক আগের ওই ঘটনায় তোলপাড় কম হয়নি। তার রেশ না-কাটতেই ফের সেই এসএসকেএম তেতে উঠেছে এক ইন্টার্নের ‘দিদিগিরি’র জেরে। অভিযোগ, মৌমিতা দাস নামে ওই ইন্টার্ন নিজেকে নির্মলবাবুর ভাইঝি হিসেবে পরিচয় দিয়ে হাসপাতালে যথেচ্ছাচার চালাচ্ছেন।
কী ধরনের যথেচ্ছাচার, এসএসকেএমের অন্দরমহল থেকে তার নমুনাও মিলছে। ডাক্তার-পড়ুয়া-চিকিৎসাকর্মীদের বড় অংশের অভিযোগ: মৌমিতা হাসপাতালের কাজকর্ম বিশেষ করেন না। ডিউটির কথা উঠলেই হামেশা তাঁর মুখে চলে আসে ‘নির্মলজেঠু’র নাম। সতীর্থ ইন্টার্ন, নার্স বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ধমক-ধামক তো আছেই, এমনকী বিভাগীয় প্রধানদের বদলি করার হুমকি দিতেও কসুর করেন না!
সব মিলিয়ে বছর চব্বিশের তরুণীটি হাসপাতালে রীতিমতো ত্রাস হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ। সূত্রের খবর, মৌমিতার ‘তুঘলকিপনা’ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তার কাছে একাধিক নালিশ জমা পড়লেও সুরাহা হয়নি। বরং ‘ভাইঝি’র দাপট দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে।
মেডিক্যাল কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী, এমবিবিএসের শেষ ধাপে পড়ুয়াদের এক বছর হরেক ওয়ার্ডে ডিউটি করে হাতে-কলমে কাজ শেখা বাধ্যতামূলক। এই ‘ইন্টার্নশিপ’ শেষ করার প্রমাণ দেখালে তবেই কাউন্সিল চূড়ান্ত রেজিস্ট্রেশন দেয়। অভিযোগ, মৌমিতা কার্যত কাজ না-করে দিব্য ইন্টার্নশিপ বজায় রেখেছেন। মাস গেলে অক্লেশে ভাতাও তুলছেন। অর্থোপেডিক, গাইনি, মেডিসিন, ইএনটি-সহ বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়র ডাক্তারেরা ইতিমধ্যে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের গোচরে এনেছেন। ইন্টার্নদের দু’মাস আইডি’তে কমিউনিটি মেডিসিনের কাজ করার যে নিয়ম, মৌমিতা তা-ও মানেননি বলে অভিযোগ।
তবু কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেননি। কেন?
জবাবে ‘জেঠু’র প্রতিপত্তির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষের একাংশ। এক কর্তার কথায়, ‘‘মেয়েটি সব সময় মন্ত্রের মতো নির্মলজেঠুর নাম আওড়ায়। জেঠুও হাসপাতালে এলে ভাইঝিকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে, ব্যবস্থা নেব?’’ এক প্রবীণ চিকিৎসকও নিজের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিচ্ছেন। কী রকম?
এক রবিবার মৌমিতার ডিউটি ছিল ইমার্জেন্সিতে। ‘‘প্রচণ্ড চাপ। তার মধ্যে উনি বারবার শুধোচ্ছিলেন, কখন বাড়ি যাব? এক সিনিয়র ডাক্তার জানিয়ে দেন, বিকেল চারটে পর্যন্ত ডিউটি, ততক্ষণ থাকা দরকার।’’— বলছেন ওই প্রবীণ চিকিৎসক। তাঁর দাবি, মৌমিতা তখন কিছু না-বললেও খানিক বাদে ওঁর মা পরিচয় দিয়ে এক মহিলা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে ফোন করেন। কৈফিয়ৎ চান, তাঁর মেয়েকে চারটে পর্যন্ত ডিউটি করতে বলা হল কোন সাহসে?
বৃত্তান্ত জানিয়ে প্রবীণ চিকিৎসকের আক্ষেপ, ‘‘পঁচিশ বছর সরকারি হাসপাতালে চাকরি করছি। এমনটা কখনও দেখিনি, শুনিওনি।’’ বস্তুত মৌমিতাকে কাজ করতে বলার ‘অপরাধে’ একাধিক চিকিৎসককে ‘জেঠু’র কোপে পড়তে হয়েছে বলে হাসপাতাল-সূত্রের ইঙ্গিত।
তা নির্মল মাজি মৌমিতা দাসের কেমন জেঠু?
নির্মলবাবুর ঘনিষ্ঠমহলের খবর, মৌমিতার পরিবারের সঙ্গে নির্মলবাবুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা রয়েছে। ‘‘মৌমিতার সঙ্গে ওঁর প্রায় নিত্য যোগাযোগ। হাসপাতালের বহু খবর উনি মৌমিতার মুখ থেকে পান।’’— দাবি নির্মলবাবুর ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার নির্মলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘কে মৌমিতা? আমার সাত পুরুষে কেউ ওকে চেনে না!’’ যদিও পরক্ষণেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি তো মৌমিতাকে এ সব করতে বলিনি! কেন করছে? ওকে বলবেন, আমি প্রশ্রয় দেব না। ডিউটি না-করলে একটা পয়সাও পাবে না।’’
তৃণমূল চিকিৎসক-নেতাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, কাউকে কারও হয়ে বার্তা দেওয়াটা সংবাদমাধ্যমের কাজ হতে পারে না। তা ছাড়া উনি তো বলেই দিলেন, মৌমিতা নামে কাউকে চেনেন না?
‘‘না, চিনি না।’’— কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে উত্তর দেন নির্মলবাবু। এ-ও বলেন, ‘‘আমাকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করবেন না। আমি এমএলএ। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতিও বটে। আমার অনেক সম্মান রয়েছে।’’
বিধায়ক ও রাজ্য মে়ডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতিত্বেই নির্মল মাজির দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনেরও মাথা তিনি। এবং শাসকদলের এ হেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ চিকিৎসক-নেতাকে নিয়ে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিতর্কও যেন অন্তহীন। যেমন কুকুর-কাণ্ডের পরে নির্মলবাবুর ডাক্তারি-পড়ুয়া ছেলেকে কেন্দ্র করে বিতর্কে বাঁধে। নির্মলবাবুর ছেলে কেপিসি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএসের ছাত্র। তাঁর ফার্স্ট এমবিবিএস প্রফেশনাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল জোকা ইএসআই মেডিক্যাল কলেজে। অভিযোগ, জোকায় ফোন করে নির্মলবাবু আবদার ধরেছিলেন, ছেলের পরীক্ষা চলাকালীন যেন সিসিটিভি বন্ধ করা থাকে। আর ছেলে যেন নিজের মর্জিমাফিক জায়গায় বসে উত্তর লিখতে পারে।
জোকা মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ আবদার মানেননি। যার দরুণ দু’তরফে কিঞ্চিৎ বাদানুবাদও হয়। অভিযোগ, এসএসকেএমে মৌমিতার ক্ষেত্রেও এমন কাণ্ড ঘটেছে, তবে প্রকাশ্য প্রতিবাদের অবকাশ থাকেনি। ‘‘এক বার পরীক্ষার সময় মৌমিতা এসে বলেছিলেন, নির্মলজেঠু নাকি তাঁর ব্যাপারটা আমাদের মাথায় রাখতে বলেছেন!’’— অভিযোগ এক বিভাগীয় প্রধানের। কোন ব্যাপারটা, তার ব্যাখ্যা তিনি অবশ্য মৌমিতার কাছে চাননি। ‘‘কারণ, ওঁর মুখে এমন কথা শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বুঝে গিয়েছি, প্রতিবাদ করে লাভ তো হবেই না, উল্টে নিজের ক্ষতি।’’
সত্যিই কি তা-ই? কর্তারা কী বলেন?
পুরো বিষয়টি জেনে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এ আবার কী? আমি তো কিছুই জানি না!’’ তবে এসএসকেএমের অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, ‘‘অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেব।’’ যাঁকে ঘিরে এত কাণ্ড, তাঁর কী বক্তব্য?
এ দিন সন্ধ্যায় মৌমিতার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমেই তিনি ছুড়ে দেন পাল্টা প্রশ্ন— ‘‘আমার সম্পর্কে হঠাৎ এত খোঁজখবর কেন?’’ কারণটা শুনে বলেন, ‘‘কারা কারা আমার সম্পর্কে নালিশ করেছেন, নামগুলো বলুন।’’ তালিকায় অধিকাংশ বিভাগীয় প্রধানই রয়েছেন শুনে ওঁর মন্তব্য, ‘‘সকলেই বলেছেন? তা হলে আর কী বলব?’’ মৌমিতার দাবি, তিনি কী কী কাজ করেছেন, সে প্রমাণ মজুত রয়েছে। কী প্রমাণ জানতে চাইলে ওঁর উত্তর, ‘‘হাসপাতালের খাতায় সই করা আছে।’’
কিন্তু গত ক’দিন তো ওঁকে হাসপাতালে দেখাই যাচ্ছে না! কেন?
মৌমিতা এ দিন জানান, তাঁর ডেঙ্গি হয়েছে। ‘‘পশ্চিমবঙ্গের কোনও হাসপাতালে কোনও ডাক্তার কি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও কাজ করেছেন? খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবেন প্লিজ।’’— বলেই ফোন কেটে দেন মৌমিতা।
অবশ্য এ দিন বিকেলে মৌমিতা দাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলটি উধাও হয়ে যায়। রাত পর্যন্ত তা ফেরত আসেনি।