বড় শিমুলিয়ায় জখম এক ব্যক্তি। বোলপুর হাসপাতালে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
দু’দিন আগেই জনসভা করে এলাকার ‘দুষ্কৃতী’দের বিরুদ্ধে কামান দেগেছিল গোটা তৃণমূল নেতৃত্ব। আর তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দলের দু’গোষ্ঠীর সংঘর্ষে রক্ত ঝরল বোলপুর থানার বড় শিমুলিয়া গ্রামে। মঙ্গলবার সকালে অজয় নদ লাগোয়া ওই গ্রামে দফায় দফায় বোমা-বন্দুকের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ল তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী এবং নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখের গোষ্ঠী। দিনের শেষে দু’জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি তিন মহিলাও জখম হয়েছে। একাধিক বাড়িতে লুঠপাট চালানো ছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তিনটি বাড়ি।
দুই গোষ্ঠীরই অবশ্য দাবি, এ দিনের ঘটনায় দলের কেউ জড়িত নয়। বহিরাগত দুষ্কৃতীরাই ওই তাণ্ডব চালিয়েছেন। ঘটনায় গুলিবিদ্ধ দু’জনকে প্রথমে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁদের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। উত্তেজনা থাকায় এসডিপিও (বোলপুর) অম্লানকুসুম ঘোষের নেতৃত্বে বোলপুর থানার আইসি প্রবীরকুমার দত্ত বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে এলাকায় যান। পুলিশ ও কমব্যাট বাহিনী বাহিনীকে দিয়েও এলাকা টহল দেওয়ানো হয়। পরে ওই ঘটনায় মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে কাজল শেখ গোষ্ঠী। যাদের মধ্যে মুখ্য অভিযুক্ত বড় শিমুলিয়ারই তৃণমূল কর্মী শেখ হাসিম এবং শেখ নাসিম। বহু চেষ্টা করেও এ দিন জেলার পুলিশ সুপারের প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
নানুরের দাপুটে তৃণমূল নেতা কাজল শেখের (কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই) সঙ্গে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধ দীর্ঘ দিনের। বেশ কয়েক দিন ধরেই নানুরের রাজনৈতিক রাশ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে অনুব্রতর অনুগামীরা। গত রবিবারই কাজলের খাসতালুক নানুরে জেলা পর্যবেক্ষক ফিরহাদ হাকিম-সহ প্রায় সমস্ত নেতা-কর্মীকে হাজির করে বিশাল জনসভা করেন অনুব্রত। কাজলের নাম না করেই ওই দিন ‘ক্রিমিনাল’দের বিরুদ্ধে পুলিশকে কড়া হওয়ার বার্তা দেন তৃণমূল নেতারা। আর তার পর থেকেই উত্তপ্ত গোটা এলাকা। মঙ্গলবার বাহিরী-পাঁচশোয়া পঞ্চায়েতের বড় শিমুলিয়া এলাকার ঘটনা তারই ফলশ্রুতি বলে দাবি দলেরই একটি সূত্রের।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, জনসভায় উজ্জ্বীবিত অনুব্রত অনুগামীদের সঙ্গে সোমবার রাতেই একচোট বচসা হয়েছিল কাজল গোষ্ঠীর লোক জনদের। এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে সেই লড়াই-ই এ দিন সকালে বোমাবাজি ও গোলাগুলির চেহারা নেয় বলে খবর। গ্রামের হরিপাড়ার বাসিন্দা তথা কাজল গোষ্ঠীর রফিকুল শেখের অভিযোগ, ‘‘ভোর ৬টা নাগাদ গ্রামেরই বাসিন্দা দুষ্কৃতী শেখ হাসিম আর শেখ নাসিমের নেতৃত্বে জনা পঁচিশ বহিরাগত দুষ্কৃতী বোমা বারুদ মারতে মারতে গ্রামে ঢোকে। এলোপাথোড়ি গুলি চালাতে থাকে। আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে অবাধ লুটপাট চালায়। আমার ভাইপো মিঠু শেখের বাড়িতে আগুন দেয়। মিঠুকে গুলি করে। ছোট ভাই শফিকুল শেখের স্ত্রী পারুল বিবিকে বোমা মারে।’’ দুষ্কৃতীরা গ্রামেরই বাসিন্দা মতু শেখের স্ত্রী জগিয়া বিবিকে এবং ও বেধড়ক মারধর করে। নিজের জামাইয়ের বাড়ি আসা সাওতা গ্রামের বাসিন্দা আকরমা বিবিকে বোমা মারে বলে তাঁর দাবি।
এ দিনের সংঘর্ষে মিঠু শেখের পায়ে গুলি লেগেছে। আর এক বাসিন্দা হাসপাতাল শেখের ছেলে বরজাহান শেখও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁর হাতে দু’টি গুলি লেগেছে। তাঁর অভিযোগ, শেখ হাসিম এবং শেখ নাসিমই লাগোয়া আউসগ্রাম থেকে দুষ্কৃতীদের জড়ো করে অজয় নদ পেরিয়ে এই গ্রামে হামলা চালানোর জন্য ছক কষেছিল। দু’জনেই এলাকায় জেলা সভাপতি গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত। যদিও কাজল গোষ্ঠীর এই ব্যাখ্যাকে মিথ্যা বলে দাবি করেছে বিরোধী গোষ্ঠী। অনুব্রতর গোষ্ঠীর কর্মী তথা একই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল রহমানের দাবি, ‘‘স্থানীয় বাসিন্দা শেখ কালোর নেতৃত্বে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা গ্রাম দখল করতে এসেছিল। হামলার জেরে এলাকার বাসিন্দা শেখ হাসিম এবং শেখ নাসিম-সহ একাধিক মানুষ গ্রামছাড়া। এ দিন ফোনে একই দাবি করেছেন শেখ হাসিমও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওরাই (কাজল গোষ্ঠী) দুষ্কৃতী নিয়ে গ্রামে হামলা করেছে। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি। ফের হামলার ভয়ে গ্রামে ঢুকতে পারছি না।’’ নিজেদের ছোড়া বোমা-গুলিতেই মিঠু শেখরা জখম হয়েছেন বলে তাঁর দাবি।
নিচুতলার কর্মী-সমর্থকেরা এমন দাবি করলেও দুই গোষ্ঠীর নেতারা অবশ্য ঘটনায় দলের কেউ জড়িত নয় বলেই দাবি করেছেন। অনুব্রতর অনুগামী তথা নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা বলেন, ‘‘কিছু বহিরাগত দুষ্কৃতী ওই গ্রামে লুঠপাট চালাতে এসেছিল। বাসিন্দারা তা প্রতিরোধ করেছেন।’’ তাঁদের কট্টর বিরোধী বলে পরিচিত কাজল শেখেরও একই বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘‘ওই গ্রামের কিছু সমাজবিরোধী আউসগ্রাম থেকে কিছু ভাড়াটে দুষ্কৃতী এনে গ্রাম দখল করার চেষ্টা করেছিল। তারা বোমাবাজি করেছে, গুলি চালিয়েছে। মানুষ রুখে দাঁড়ানোয় বাড়িতে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় গ্রামের দু’জন গুলিবিদ্ধ। তিন মহিলাকেও মারধর করা হয়েছে।’’ দুষ্কৃতীরা কি তৃণমূলের জেলা সভাপতির গোষ্ঠীর লোক? কাজলের জবাব, ‘‘ওরা দুষ্কৃতী, সমাজবিরোধী। ওদের কোনও দল নেই।’’ বহু চেষ্টা করেও এ দিন তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রতর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।