মনসারাম সর্দার এবং (ডান দিকে) জিতেন মাহাতোর আঘাত।
ঝাড়গ্রামের মন্মথ মাহাতো, জগদীশ মাহাতো, হরিপদ মাহাতো, ইন্দ্রাণী মাইতিরা নবান্নে গিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর দেখা পাননি। লালগড়ের শ্রীদামবাবু, জিতেন, মনসারাম সর্দার-সহ ন’-দশ জন আবার সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
দু’দলের দাবিটাই এক। এঁদের প্রত্যেকেই মাওবাদী হামলায় হয় স্বজনকে হারিয়েছেন অথবা নিজেরাই জখম হয়েছেন। বছর তিনেক আগে জঙ্গলমহলের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, রাজ্যে মাওবাদী সন্ত্রাসপর্বে নিহতদের পরিবারকে চাকরি বা পেনশন দেওয়া হবে। কার্যক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠেনি।
কেন হয়নি, সেই প্রশ্নই তুলেছিলেন ঝাড়গ্রামের দলটি। নবান্ন ফিরিয়ে দেওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ। মঙ্গলবার লালগড়ের দলটির চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে এসে পৌঁছলেও কবে আর্থিক সাহায্য পাবেন, জানেন না তাঁরা। লালগড়ের ডাইনটিকরি গ্রামের বছর ৩৯-এর মনসারাম বাঁ হাতের ক্ষত ঢাকতে হাফ শার্ট বা টি-শার্ট পরেন না। ২০১০-এর ৩ ফেব্রুয়ারি দোনলা বন্দুক থেকে ছোড়া মাওবাদীদের দু’টো গুলি ঢোকে ওই হাতে। দিনমজুর মনসারামের কথায়, ‘‘একাধিক অস্ত্রোপচারের পরে বাঁ হাত অচল।’’
মনসারামের মতো বাঁ হাতে হাল্কা কাজও করতে পারেন না বোনিশোল গ্রামের জিতেন মাহাতো। বাঁ হাতটা অক্ষত থাকলেও মাওবাদীদের রাইফেলের গুলি পিঠের বাঁ দিকে ঢুকে বাঁ কাঁধ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ২০০৯-এর জুনে। কাঁধের হাড় কেটে বাদ দেওয়ায় বাঁ হাত অকেজো।
গোয়ালডাঙার শ্রীদাম মণ্ডলের অন্য সমস্যা। শ্বাসকষ্ট। মাঝেমধ্যে বুকে-পিঠে তীব্র জ্বলুনি। প্রবীণ শ্রীদামবাবুর বুকে মাওবাদীরা গুলি করে পাঁচ বছর আগে। জিতেন, মনসারাম, শ্রীদামবাবু-সহ লালগড়ের ন’-দশ জনের কর্মক্ষমতা এ ভাবেই হ্রাস পেয়েছে। চিকিৎসার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। কেউ জমি বেচে, কেউ স্ত্রীর গয়না বেচে চিকিৎসা করালেও মাথায় বিপুল ঋণের বোঝা। অনেকে অর্থাভাবে মাঝপথেই চিকিৎসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
ঝাড়গ্রামের সবার মতো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ওঁদেরও প্রশ্ন, ‘যে সব মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেনি, তাদেরও পুনর্বাসন প্যাকেজ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। এমনকী, মাওবাদী বা মাওবাদীদের সমর্থক, যাদের বিরুদ্ধে পুলিশে মামলা নেই, তাদেরও এই প্যাকেজ দেওয়া হবে। আমরা যারা মাওবাদীদের হাতে জখম হয়ে আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত এবং শারীরিক ভাবে অসুস্থ ও কর্মক্ষমতাহীন, তারা কেন আপনার সরকারের দয়া থেকে বঞ্চিত হব?’ স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি নথি অনুযায়ী, ২০১৪-র মে পর্যন্ত আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের বিভিন্ন প্রকল্পে মোট আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ১ কোটি ৫০ হাজার ৮৫০ টাকা। এ বছর ৩০ সেপ্টেম্বর মাওবাদীদের জন্য আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতি শিথিল হওয়ার পরে বুধবারই জঙ্গলমহলের ৮৬ জনকে প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা নেই এবং এরা আত্মসমর্পণও করেনি।
লালগড়ের পাঁপুড়িয়া গ্রামের উজ্জ্বল কুণ্ডুকে ছ’বছর আগে হাতে ও পায়ে গুলি করে মাওবাদীরা। পেশায় কৃষক উজ্জ্বলবাবু লাখ দুয়েক টাকা খরচ করে প্রাণে বেঁচেছেন। কিন্তু ভাল করে হাঁটতে পারেন না। উজ্জ্বলবাবুর কথায়, ‘‘আগে যা কাজ করতাম, গুলি লাগার পরে তার অর্ধেকও পারি না। রোজগারও কমেছে। দেনা শোধ করতে পারছি না। সরকারি সাহায্য পেলে মাথা তুলে বাঁচতে পারতাম।’’
একই বক্তব্য ঝাঁটিবনির অজিত হেমব্রম, জিরাপাড়ার ত্রিলোচন সামন্তের। তাঁরা জানান, যখন থেকে হাঁচাটলা করতে পারছেন, তখন থেকে স্থানীয় থানা, জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের সদর দফতরে গিয়ে বার বার আবেদন জানিয়েছেন। শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার দাবি, ‘‘মাওবাদীদের হাতে নিহতের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। জঙ্গলমহলের অনেকেই এককালীন অর্থসাহায্য পেয়েছেন। আহতদের পরিবারকে সাহায্য করার সরকারি নীতি নেই।’’
স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, এই বছরের গোড়ায় রাজ্য মাওবাদী হামলায় নিহতদের পরিবার পিছু আট লক্ষ টাকা এককাকালীন সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রাজ্যের ভাগ অর্ধেক। বাকি চার লক্ষের তিন লক্ষ কেন্দ্র দিচ্ছে বিশেষ প্রকল্প সিকিউরিটি রিলেটেড এক্সপেনডিচার (এসআরই) থেকে।
নবান্ন সূত্রের খবর, এসআরই স্কিমে মাওবাদী হামলায় প্রতিবন্ধীদের জন্য আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। রাজ্যের কেউ এখনও সেই সাহায্য পাননি বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর।