নিরুপম খাঁড়া
ওঁর দাপটে তটস্থ জেল। কয়েদি নয়, খোদ কারা-কর্তাদেরই ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি নিরুপম খাঁড়া। রাজ্যের তৃণমূল-সমর্থিত জেলরক্ষী সংগঠনের নেতা। শাসকদলের প্রতিপত্তির সুবাদে যিনি কিনা কারা মহলে রীতিমতো সন্ত্রাসের রাজ কায়েম করেছেন বলে অভিযোগ। কর্তারা বলছেন, খাঁড়াবাবুর নির্দেশ মানলে ভাল, নচেৎ আক্ষরিক অর্থেই তিনি খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর হুমকিবাজির তালিকায় বিভিন্ন জেলের ছোট-মাঝারি অফিসারেরা তো আছেনই, বাদ যাচ্ছেন না জেলের সুপারেরাও!
প্রশাসনিক মহলের খবর, গত ক’মাসে এ নিয়ে ভুরি ভুরি নালিশ কারা দফতরে জমা পড়েছে। কোনও সুরাহা হয়নি। দফতরের অন্দরের ইঙ্গিত, খাঁড়াবাবুর হাত নাকি এতটাই লম্বা যে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া স্বয়ং কারামন্ত্রীরও সাধ্যের বাইরে!
কারা-সূত্রে জানা যাচ্ছে, পালাবদলের পরে পরে শাসকদলের কারারক্ষী সংগঠন ‘বঙ্গীয় কারারক্ষী সমিতি’র নেতা হয়ে ওঠেন নিরুপম। শুরু করেন ছড়ি ঘোরানো। অভিযোগ, প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালীন বেশ ক’মাস তিনি কাজই করেননি। এমনকী, হাজিরা খাতাতে নিয়মিত সই করারও তোয়াক্কা করেননি। প্রেসিডেন্সি জেল কর্তৃপক্ষ বারবার দফতরকে জানিয়েও ফল পাননি। এ বছরের গোড়ায় তাঁকে বদলি করা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। দফতর-সূত্রের অভিযোগ, সেখানে শাসকদল-সমর্থিত কারা-অফিসার সংগঠনের নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন নিরুপমবাবু। সীমা ছাড়িয়েছে তাঁর পরাক্রমও।
কী রকম?
সূত্রের খবর: কারারক্ষীদের পোস্টিং থেকে শুরু করে জেলের নিয়মকানুন— কার্যত সব ব্যাপারে নিরুপম নিয়মিত নাক গলাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, জেল সুপারেরা তাঁর ‘নির্দেশ’ না-মানলে অকথ্য গালি-গালাজ করতেও কসুর করছেন না!
বস্তুত এমনই একটি ঘটনার প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি রাজ্যের এডিজি-আইজি (কারা) অধীর শর্মার দ্বারস্থ হয়েছেন বহরমপুর জেলের সুপার নন্দন বড়ুয়া। এডিজি-কে লেখা চিঠিতে সুপারের অভিযোগ: সমিতির কয়েক জনের বদলি নিয়ে মতবিরোধের জেরে নিরুপমবাবু তাঁকে ফোনে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনি কোন লাটের বাট হয়ে গেছেন! আপনাকে ওই চেয়ার থেকে ছুড়ে ফেলে দেব। চাকরির বারোটা বাজিয়ে দেব। একদম বাঁশ করে দেব!’
এতেই শেষ নয়। এর পরে নিরুপমবাবু কদর্য ভাষায় গালিগালাজও করেন বলে চিঠিতে জানিয়েছেন সুপার। ‘‘ওই সব অশ্রাব্য কথা আমি লজ্জায় লিখতে পারছি না।’’— চিঠির উপসংহারে বলেছেন তিনি।
চিঠি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে নন্দনবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে দফতরের মাথাদের কারও কারও বক্তব্য, আগেও ক’বার ঊর্ধ্বতন অফিসারদের শাসানি, কটূক্তিতে খাঁড়াবাবুর নাম জড়িয়েছে। এমনকী, ক’দিন আগে আলিপুর মহিলা জেলের সুপারকে তিনি খুনের হুমকিও দেন বলে অভিযোগ। আরও জানা গিয়েছে, কিছু দিন আগে শাসকদলের দুই বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে নিরুপমবাবু আলিপুর জেলের ভিতরে ঢুকতে গিয়েছিলেন। সুপার বাধা দিলে প্রবল বচসা বাঁধিয়ে দেন। আলিপুরের এক কারা-কর্মীর আক্ষেপ, ‘‘ভাবা যায় না! দফতরের হর্তা-কর্তারা সবই জানেন। সুপারেরাও মৌখিক নালিশ করেছেন। তবু কোনও ব্যবস্থা হয়নি।’’
নিরুপম পার পেয়ে যাচ্ছেন কোন জাদুতে?
নেপথ্যের রহস্যটা নিরুপমবাবু নিজেই নাকি খোলসা করে দিয়েছেন কর্তাদের সামনে। ‘‘উনি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে কর্মরত তৃণমূলের সরকারি কর্মী সংগঠনের এক নেতার সঙ্গে ওঁর দারুণ খাতির। বেশ কিছু প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমএলএ’র সঙ্গেও নাকি নিত্য ওঠা-বসা। তাই হাজার নালিশ করেও ওঁর গায়ে আঁচড় কাটা যাবে না।’’— বলেন এক কর্তা। দফতর-সূত্রের ইঙ্গিত, এর আগে কারামন্ত্রীর ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে রক্ষী-বদলির তালিকায়নিরুপম হস্তক্ষেপ করেছিলেন নবান্নের ওই কর্মী-নেতারই মদতে।
কারাগারে খাঁড়া-রাজ নিয়ে মন্ত্রী কী বলছেন? কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফির সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘এমন অভিযোগ শুনিনি। কিছু বলতে পারব না।’’ যদিও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যে স্পষ্ট, নিরুপমবাবুকে নিয়ে কিছু একটা সমস্যা আছে। ‘‘এডিজি ও কারারক্ষী সমিতির সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করব।’’— বলেন পার্থবাবু। যাঁকে ঘিরে এত বিতর্ক, সেই নিরুপম খাঁড়া অবশ্য সব অভিযোগ নস্যাৎ করে বলেছেন, ‘‘সব মিথ্যে কথা। মন্ত্রী থেকে এমপি, সবাই আমাকে চেনেন। সবাই জানেন, আমি কেমন লোক।’’
শাসকদলের ছাত্রনেতা সৌরভ অধিকারী, অশোক রুদ্র বা বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারির সঙ্গে তাঁকে ইতিমধ্যেই কিন্তু একাসনে বসিয়েছে প্রশাসনের একাংশ। এই মহলের পর্যবেক্ষণ: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-শিক্ষকদের হেনস্থায় ওই ছাত্রনেতাদের দিকে আঙুল উঠেছে, বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ মহিলা ডিএম’কে অশ্লীল গালিগালাজের। অথচ সরকার ব্যবস্থা নেয়নি। ‘‘শাসকদলের ছাতা থাকলে সাত খুন মাফ! কাজেই নিরুপম খাঁড়াও পার পেয়ে যাবেন, এতে আশ্চর্য কী?’’— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন নবান্নের এক আধিকারিক।