মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
আর তিরিশ সেকেন্ড দেরি হলে হেলিকপ্টার ভেঙে পড়তে পারত। কোনও মতে তিনি রক্ষা পেয়েছেন— নির্বাচনী প্রচারে উত্তরবঙ্গের কপ্টার বিভ্রাট নিয়ে এমনই তথ্য জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ক’দিন আগে ভোট প্রচারে গিয়ে দুর্যোগের কবলে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর চপার। পায়ে ও কোমরে আঘাত পান মমতা। বাড়িতেই তাঁর চিকিৎসা চলছে। তার ফলে সোমবার বীরভূমের দুবরাজপুরে সভা করার কথা থাকলেও সেখানে আসতে পারেননি মমতা। বদলে সারদা ময়দানে নির্বাচনী সভায় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভাষণ দেন তিনি। পঞ্চায়েতের প্রচারেও বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি, জেলবন্দি অনুব্রত মণ্ডলের পাশেই দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। একই দিনে গোঘাটের বদনগঞ্জে বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ফোন মারফত ভাষণে পঞ্চায়েত ভোটে দলীয় প্রার্থীদের জেতানোর আবেদন করেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘গত বিধানসভা ভোটে আপনারা ভুল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকের জন্য লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যকাথী কার্ড, বাধর্ক্য ভাতা, বিধবা ভাতা করে দিয়েছি।’’
বীরভূমে ফোন-বক্তৃতায় মমতা এ দিন বলেন, ‘‘আমি এমনি ঠিক আছি। তবে আমার কোমরে আর পায়ে চোট আছে। আর ৩০ সেকেন্ড হলেই হেলিকপ্টারটা ক্র্যাশ হয়ে যেত, নষ্ট হয়ে যেত! এই অবস্থায় আপনাদের আর্শীবাদ ও দোয়ায় কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছি। দুর্ঘটনা হলে যে মানুষটা মরে যেতে পারত, তার সম্পর্কেও বিরোধীরা অপপ্রচার করছে! আমি বিচার চাইব জনগণের কাছে।’’ তিনি জানান, তাঁর সুস্থ হতে আরও ৭-৮ দিন লাগবে। দু’একটা ছোট অস্ত্রোপচার করাতে হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে হয়তো আপনাদের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারছি না। কিন্তু মন ছটফট করছে। যেতে না পারলেও আপনারা যখন পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন করবেন, নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে থাকব।’’ শরীর খারাপ থাকলেও মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তৃতা ছিল চড়া সুরে বাঁধা। একযোগে তিনি আক্রমণ করেছেন বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএমকে। মমতা জেলবন্দি অনুব্রতের কথাও বলেছেন। জেলা সভাপতির পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কেষ্ট আজকে নেই। কিন্তু কেষ্ট আমাদের সকলেরই ঘরের ছেলে। ওকে ইচ্ছে করে ফাঁসানো হয়েছে। ওর মেয়েকে পর্যন্ত আটকে রেখে দেওয়া হয়েছে।’’ মমতার সংযোজন, ‘‘অন্যায় করলে আদালতে প্রমাণ করুন। প্রমাণ করতে পারছে না। শুধু বিনা বিচারে আটকে রেখেছে। ও যাতে তৃণমূল বা পঞ্চায়েত করতে না পারে।’’
কেষ্ট-প্রসঙ্গে পাল্টা সরব হয়েছে বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কেষ্টর পাশে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কারণ, কেষ্ট যদি মুখ খোলে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার পর্যন্ত বিপদে পড়বে।ভারতে এই প্রথম কোনও মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এমন নির্লজ্জ ভাবে এক জন চোরের পাশে দাঁড়ালেন!’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘বীরভূমে মুখ্যমন্ত্রীর ভার্চুয়াল বৈঠকে আবার বোঝা গেল, তিনি দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতীদের পাশে আছেন! অনুব্রত যে দুর্নীতিবাজ এবং অন্যায় করেছেন, এটা আজ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী বোঝেননি মানে তিনি বুঝতে চান না। দুষ্কৃতীদের মাথায় ছাতা ধরে আছেন।’’
কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের প্রক্রিয়া চললেও রাজ্য স্তরে বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেসকে এক বন্ধনীতে ফেলেই ফের বিঁধেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘(সিপিএম) দিল্লিতে বলছে, চলো বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করব। আর এখানে এসে চলো মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করব! একই জিনিস চলছে কংগ্রেসেও। ওরা লড়াই করছে (বিজেপির বিরুদ্ধে) ঠিকই, আমিও আছি। কিন্তু ওরাই এখানে এসে বলছে, চলো মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করি। দিল্লিতে এক লাড্ডু আর বাংলায় আর এক লাড্ডু— দু’টো তো হয় না!’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিনই আবার পাল্টা বলেছেন, ‘‘আপনার (মমতা) আমলে বিধানসভায় সংখ্যালঘু বিধায়কের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, উল্টো দিকে বিজেপি দুই থেকে ৭৭-এ পৌঁছে গিয়েছে। আপনি ধরা পড়ে গিয়েছেন! সংখ্যালঘু মানুষ যখন চিহ্নিত করে ফেলেছে আপনাকে, তখন সেই অধীর চৌধুরীকে বিজেপি বানাও, বিজেপির সঙ্গে সবাইকে মিলিয়ে দাও— এই কৌশল নিয়েছেন। বাংলায় যারা লুট করল, পঞ্চায়েতে মেরে খেল, তারা এখন মানুষকে শেখাচ্ছে যে, বিজেপি কংগ্রেসের মধ্যে জোট হয়েছে!’’
বিরোধীদের প্রতি রাজনৈতিক আক্রমণের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রাখার জন্যও। তাঁর কথায়, ‘‘আজ ওরা আমেরিকার কাছে ২৪ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ড্রোন কিনতে পারে। ফ্রান্সের কাছে অনেক অনেক টাকা দিয়ে বিমান কিনতে পারে। অথচ ১০০ দিনের টাকাটা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলার ঘর বাংলার বাড়ি, সেটার টাকাও বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রামীণ রাস্তা টাকা বন্ধ করে দিয়েছে।’’
একই সুরে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ দিন পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির সভায় বলেছেন, ‘‘১০০ দিনের প্রকল্পে রাজ্যের বকেয়া টাকা আটকে দিয়েছে কেন্দ্র। সেই টাকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রচারে। বাকি আড়াই হাজার কোটি টাকায় উত্তরপ্রদেশে রামমন্দির তৈরি হচ্ছে। আবাস যোজনায় রাজ্যের আট হাজার কোটি টাকা বকেয়া। সেই টাকায় প্রধানমন্ত্রী বিলাসবহুল বিমান কিনছেন!’’ পুরুলিয়ার ওই সভা থেকে তাঁর আরও অভিযোগ, বাংলার প্রাপ্য টাকা উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরার মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিকে দেওয়া হচ্ছে।