ভাইপো নিয়ে কটাক্ষ করে সরাসরি দলনেত্রীকে আক্রমণের রাস্তায় হাঁটলেন এক জন। সরাসরিই জানিয়ে দিলেন, তিনি মুকুল রায়ের পক্ষে!
আর এক জনের পরিষদীয় সচিব পদ কেড়ে নিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পদ হারানোর পরেও তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, মুকুলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে অসুবিধা কী?
প্রথম জন তৃণমূলের প্রাক্তন মুর্শিদাবাদ জেলা কার্যকরী সভাপতি হুমায়ুন কবীর। দল-বিরোধী কাজের জন্য ইতিমধ্যেই যাঁকে শো-কজ করেছে তৃণমূল। যিনি বুধবার সদর্পে জানিয়ে দিলেন, অচিরেই তৃণমূল ভেঙে বেরিয়ে আসবেন একগুচ্ছ বিধায়ক। সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। তখন মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
দ্বিতীয় জন ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত। প্রায় আচমকাই নবান্নে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ দিন যাঁকে পরিষদীয় সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিধানসভার অধিবেশনে না থেকে যিনি এখন রয়েছেন মুকুলের সঙ্গে দিল্লিতে।
তৃণমূলের রাজনীতিতে দু’জনেরই পরিচিতি মুকুল-শিবিরের নেতা হিসাবে। তৃণমূল নেত্রীকে এক জনের বেপরোয়া আক্রমণ এবং অন্য জনের পদ হারানোর জোড়া ঘটনায় আরও স্পষ্ট মমতা বনাম মুকুল দ্বৈরথ। দলের অন্দরে ইতিমধ্যেই জল্পনা চলছে, তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জোড়াফুল প্রতীক হয়তো নিজের কাছেই রাখতে চাইবেন মুকুল। রাখতে চাইবেন আসন্ন পুরভোটে সেই প্রতীক দেওয়ার অধিকার। ঘটনা সত্যিই এই পর্যায়ের টানাটানির দিকে যাবে কি না, উত্তর দেবে সময়ই। কিন্তু হুমায়ুন-শীলভদ্রকে নিয়ে জোড়া ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে, প্রায় প্রতিদিন মমতা-মুকুল সম্পর্ক এগোচ্ছে বিচ্ছেদের পথে!
মুকুল অবশ্য এখনও রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ক্রিজ আঁকড়ে আছেন। বিগ হিট নিতে যাচ্ছেন না একেবারেই! কলকাতায় বিধায়ক স্বপন ঘোষ দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ধর্নায় বসে সাসপেন্ড হয়েছেন, মুর্শিদাবাদে হুমায়ুন দলনেত্রীকে তীব্র আক্রমণে গিয়েছেন, শীলভদ্র পদ হারিয়েছেন। এত কিছুর পরেও দিল্লিতে বসে মুকুলের মন্তব্য, “এই নিয়ে আমার কোনও তাপ-উত্তাপ নেই! কোনও প্রতিক্রিয়া আমি দেব না।” অবশ্য এর সঙ্গেই তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন, “অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ এখন দল চালাচ্ছেন! আমার ধারণা, তাঁরা সব রকম পরিস্থিতিই সামলাতে পারবেন!”
পরিস্থিতি অবশ্য ঢের জটিল করে দিয়েছেন হুমায়ুন। যাঁর হাত ধরে কংগ্রেস ছেড়ে তাঁর তৃণমূলে পদার্পণ, সেই মুকুলের পক্ষে ব্যাট করতে নেমে এ দিন হুমায়ুন বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সাধ হয়েছে, ভাইপোকে রাজা বানাবেন! পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁর সেই সাধ পূর্ণ করবেন না। এই মুখ্যমন্ত্রীর পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, তা উনি নির্ধারণ করতে পারেন না। নির্ধারণ করবেন জনগণ। ভাইপোকে রাজা বানানোর আশা পূরণ হবে না!”
কেন মমতার ‘সাধপূরণ’ হবে না, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি নিজের মতো করে। দাবি করেছেন, “দেখুন না, মার্চ-এপ্রিলে কী হয়! ক্ষমতায় থাকতে ১৪৯ জন বিধায়ক দরকার। তৃণমূলের এখন বিধায়ক সংখ্যা ১৯১। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন তৃণমূল থেকে চলে গেলে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে মমতার সরকার। তখন সংবিধান মেনে মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। সেই দিকেই ঘটনা এগোচ্ছে।” হুমায়ুনের ঘনিষ্ঠদের দাবি, মুর্শিদাবাদের অন্তত ৯ জন জেলা স্তরের নেতা ইতিমধ্যেই ‘মুকুলদা’র সঙ্গে রয়েছেন। রয়েছেন হুগলির অন্তত তিন বিধায়ক-সহ ১৩ জন নেতা। নদিয়া জেলা তৃণমূলের এক তাবড় নেতা-সহ তিন-চার জনবিধায়কেরও ওই তালিকায় থাকার সম্ভাবনা। আর বিক্ষুব্ধ হুমায়ুন নিজে বলেছেন, “অন্য জেলাগুলি থেকে কত জন নেতা-বিধায়ক মুকুলদার সঙ্গে আছেন, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলছি না। তবে জেনে রাখুন সংখ্যাটা বড় মাপের।”
হুমায়ুনের ঘনিষ্ঠেরা আরও জানিয়ে রেখেছেন, দল ছেড়ে বেরিয়ে দোলের আগেই নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ গড়তে পারেন মুকুল-অনুগামীরা। হুমায়ুনের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে মমতার সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা থাকতেন মুকুল রায়। রাজ্যের ৭৭ হাজার বুথের মধ্যে ৩০ হাজার বুথের কর্মীদের সঙ্গে মুকুলদার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। কংগ্রেস ছেড়ে আমি তাঁর হাত ধরেই তৃণমূলে এসেছি। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, আমিও তাই গ্রহণ করব।”
মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মার অনেকটাই যে দলের মুর্শিদাবাদ জেলার ‘পর্যবেক্ষক’ ইন্দ্রনীল সেনকে ঘিরে, তা-ও স্পষ্ট করেছেন হুমায়ুন। বলেছেন, “নেত্রী কখন, কী বলেন ভেবে পাই না। জনগণের রায়ে হেরে যাওয়া (গত লোকসভা ভোটে) ইন্দ্রনীল সেনকে মুর্শিদাবাদ জেলায় দলীয় পর্যবেক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা নেত্রী বলেছিলেন। ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর কল্যাণীর সভায় সে ঘোষণাও করা হল। আবার সেই হেরো ইন্দ্রনীলকে এখনও মুর্শিদাবাদ জেলার দলীয় পর্যবেক্ষক পদে রেখে দেওয়া হয়েছে বলে শুনছি!” ইন্দ্রনীলকে মমতা যদি নতুন করে পর্যবেক্ষক বলে ঘোষণা করেন, তা হলে অন্য কথা। নচেৎ গায়ক-নেতাকে জেলায় তাঁরা ঢুকতে দেবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হুমায়ুন। যা শুনে ইন্দ্রনীল কটাক্ষ করেছেন, “তৃণমূলের কর্মী হিসেবে বলছি, যিনি দলনেত্রী সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন, ৫০ জন বিধায়ক দল ছেড়ে বেরিয়ে সরকার ফেলে দেবেন বলে ঘোষণা করেন, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন!”
হুমায়ুনকে তৃণমূল শো-কজ করেছে ২৪ ঘণ্টা আগেই। তার পরেই তাঁর এমন বিস্ফোরণের পরে দলীয় নেতৃত্ব কী করবেন? তৃণমূল সূত্রের খবর, হুমায়ুনের ‘স্পর্ধা’য় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বয়ং মমতা। সেই মনোভাব বুঝে সম্ভব হলে আজ, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই হেস্তনেস্ত চাইছেন শাসক দলের নেতৃত্ব। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “হুমায়ুন সংবাদমাধ্যমে বা দলের বাইরে কাকে কী বলছেন, সমস্তটাই নজরে রাখছি। ওঁর বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেওয়ার, যথা শীঘ্রই নেওয়া হবে।”
শীলভদ্র অবশ্য হুমায়ুনের মতো আক্রমণে যাননি। বরং, ব্যারাকপুরের বিধায়কের ভঙ্গি অনেকটা তাঁর নেতা মুকুলের মতোই! পদ থেকে অপসারণের খবর সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে জেনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী কাকে, কখন মন্ত্রিসভা বা পরিষদীয় সচিব পদে নেবেন বা সরাবেন, তা তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমি দলে যত দিন আছি, তত দিন এক জন অনুগত সৈনিক হিসেবে দলের কাজ করে যাব।” ‘যত দিন’ মানে কি এক দিন দল ছাড়তেও পারেন? শীলভদ্র দাবি করেছেন, তেমন জল্পনার কোনও অবকাশ এখন নেই। দাবি করেছেন, তিনি দিল্লি গিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। বিধানসভার স্পিকারকে চিঠি দিয়ে সে কথা জানিয়েও এসেছেন। তবে তাঁর মুকুল-ঘনিষ্ঠতার তকমা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই শীলভদ্রের। তাঁর মন্তব্য, “মুকুলবাবু তৃণমূলেই আছেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কও আছে। এতে অসুবিধার কী হল?”
মুকুলের সঙ্গে শীলভদ্রের মতোই এ দিন দিল্লিতে ছিলেন বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত, মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়। নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনাও সেরেছেন তাঁরা। মুকুল বলেছেন, “আমি যেখানেই থাকি, সেখানে অনেক মানুষজনই আসেন দেখা করতে। ফলে, এটা কোনও আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়।” শুভ্রাংশু দাবি করেছেন, তাঁদের দল ছাড়ার খবরের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। ঘটনাপ্রবাহ দেখে তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, “রায় বাহাদুর এক জনকে দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছেন, আর এক জনকে দিয়ে জল ঢালছেন! খেলা এখন অনেক বাকি!”