প্রতীকী ছবি।
তন্ত্র সাধকেরা এখনও আছেন! তার সঙ্গে নরবলিও কি তবে রয়েছে ২০২২ সালের ভারতে?
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। একে তো কেরলে সম্প্রতি দুই মহিলাকে ‘বলি’ দিয়ে তাঁদের মাংস খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বুধবার রাতে মালদহের চাঁচলে একটি ন’বছরের বালিকার গলাকাটা দেহ উদ্ধার হয়েছে। বাড়ির কাছেই ‘তন্ত্র সাধক’ এক যুবককেই সন্দেহ করছেন স্থানীয়রা। বৃহস্পতিবার কেরলের পাথানামথিতা জেলায় আর এক ‘তন্ত্র সাধিকা’র সন্ধান মিলেছে, যিনি প্রয়োজনে শিশুদের ব্যবহার করতে পিছপা হন না। পরের পর এমন কুসংস্কারের ঘটনায় প্রশ্ন তুলেছেন বিজ্ঞান মঞ্চ এবং সচেতনতা প্রচারের সঙ্গে যুক্তরাই: তা হলে কি আমরা পিছনের দিকেই এগোচ্ছি?
ভৈরবীর সামনে নবকুমারকে বলি দিয়ে তাঁর মাংসে দেবীপুজোর নৈবেদ্য সাজাতে চেয়েছিলেন কাপালিকও। কিন্তু কপালকুণ্ডলা খড়্গ সরিয়ে ফেলায় সে যাত্রা তা সম্ভব হয়নি। বঙ্কিম-সাহিত্যের মতো এত সরাসরি না হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ গল্পে যজ্ঞনাথ কুন্ডু এক বালককে জীবন্ত মাটি-চাপা দিয়েছিলেন, যাতে যক্ষ হয়ে সেই বালক তাঁদের সম্পত্তি রক্ষা করতে পারে। গল্পগাছার সেই তন্ত্রসাধনা বা নরবলিই যেন বাস্তবে চলে এসেছে। বছর চোদ্দো আগে বীরভূমের নলহাটি থানা এলাকায় একটি কালীমন্দিরের সামনে এক ব্যক্তিকে নরবলি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পুরুলিয়াতেও শিশু নির্যাতন করে হত্যার নজির আছে সাম্প্রতিক অতীতে। তার পিছনেও অন্ধ বিশ্বাস, দাবি অনেকেরই। এ বারে অভিযোগ উঠেছে মালদহে। তবে এ ক্ষেত্রে নাবালিকাকে বলি দেওয়া হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যদিও অভিযুক্ত যুবক এবং তাঁর বাবা, দু’জনই তন্ত্রসাধনা করতেন, তাঁদের বাড়িতে সাধনার বেদী ছিল বলে স্থানীয়দের দাবি।
মালদহের ঘটনায় কার্যকারণ এখনও অজানা। কিন্তু কেরলে মহম্মদ সফি, ভগবল সিংহ এবং ভগবলের স্ত্রী লায়লার ক্ষেত্রে একটি পক্ষের ধারণা, অভাব-অনটন থেকে রক্ষা পেতেই এই নরবলি। এবং তার পরে নরমাংসে ‘ভোজ’। যা নতুন করে ‘কপালকুণ্ডলা’র কথা মনে পড়িয়ে দেয়। কেরলের পাথানামথিতাতে তন্ত্রসাধিকা বাসন্তীর ক্ষেত্রে অবশ্য বলি দেওয়ার অভিযোগ নেই। তবে শিশুদের তন্ত্রসাধনায় ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, কেরলের মতো সাক্ষরতায় এগিয়ে থাকা রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটে কী করে? পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান সচেতনতার প্রচার বহু দিন ধরে চলছে। সেখানেই বা এমন ঘটনা কী করে ঘটছে? এ রাজ্যে বিভিন্ন বিজ্ঞান সংঠনের একটি সমন্বয়ী মঞ্চে একদা রাজ্য সম্পাদক ছিলেন মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ। তিনি আঙুল তোলেন বিজ্ঞান আন্দোলনের ‘ব্যর্থতার’ দিকে। বলেন, ‘‘৩০ বছর আগেও জেলায় বিজ্ঞান সচেতনতার অনুষ্ঠানে অনায়াসে হাজার জন চলে আসতেন। এখন তা কঠিন। আমরা অবশ্যই পিছনের দিকে এগোচ্ছি।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সংবিধানে বিজ্ঞানমনস্কতাকে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা থাকলেও রাষ্ট্র থেকে শুরু করে তা-বড় সব প্রতিষ্ঠান অপবিজ্ঞান বা কুসংস্কারকেই ইন্ধন জোগাচ্ছে।’’
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইটা এক নিরন্তর প্রক্রিয়া বলে মনে করেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রও। তাঁর কথায়, ‘‘পরজীবী বা ভাইরাসের মতো কুসংস্কারও একেবারে নির্মূল হয়নি। আধুনিক সমাজও শুধু উত্তরণের পথে চলে না। পিছনের দিকে টান সক্রিয় থাকেই। এটা মাথায় রেখেই হাল ছাড়লে চলবে না।’’
বিজ্ঞান আন্দোলনের ইতিহাস লেখক তথা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেরলের মতো সাক্ষরতায় এগিয়ে থাকা রাজ্যের এমন দশা আরও বেশি হতাশা করে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘চরম কিছু একটা ঘটলে আমাদের টনক নড়ে। কিন্তু রোজ যে হাঁচি, কাশি, টিকটিকির বিচিত্র তুচ্ছতায় আমরা জীবনযাপন করি, সেটা নিজেরাই খেয়াল রাখি না।’’