একসেলেন্ট! সুপার্ব!! ফ্যাবুলাস!!!
দেড় দিনের ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০১৬’-কে এই ভাষাতেই বর্ণনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, এ বারের শিল্প সম্মেলনে ২ লক্ষ ৫০ হাজার ১০৪ কোটি টাকার নতুন লগ্নি প্রস্তাব পেয়েছে রাজ্য সরকার। যা গত বারের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। এই হিসেব যে চূড়ান্ত নয়, তা অবশ্য তখনই জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে কত লগ্নির প্রস্তাব এসেছে সব কাউন্ট করার সময় এখনও পাইনি।’’ পরে প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়, লগ্নি প্রস্তাবের পরিমাণ ২ লক্ষ ৫০ হাজার ২৫৩ কোটি ৭৪ হাজার টাকা।
মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও বলেছেন, এই সম্মেলন এবং তাতে আসা লগ্নি প্রস্তাব ‘বিরাট ব্যাপার’! কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের শরিক হতে নারাজ বিরোধী দল থেকে শুরু করে শিল্পমহলের একটা বড় অংশ। তাদের সন্দেহে সিলমোহর দিয়ে সরকারি নথিই জানাচ্ছে, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্যে বাস্তবায়িত হওয়া লগ্নির পরিমাণ ৬,৮৭১ কোটি টাকা। গড়ে বছরে ১,৩৭৪ কোটি। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর লগ্নি-দাবি শোনার পরে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর কটাক্ষ, ‘‘ওঁর সব শিল্প সম্মেলনই অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। শিল্প সম্মেলনে ব্যবসার কথা কোথায় হয়! খাওয়া-দাওয়া নাচন-কোঁদন হয়।’’
আর শিল্পমহলের বক্তব্য, যে সব লগ্নি প্রস্তাবের ঘোষণা এ দিন সম্মেলন মঞ্চ থেকে করা হয়েছে, তার অধিকাংশই এসেছে, হয় কেন্দ্রীয় সরকার না হয় কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার সৌজন্যে। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতার বাজারে বেসরকারি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে এখনও পশ্চিমবঙ্গ বেশ পিছিয়ে। শুধু তা-ই নয়, লগ্নির এমন বহু দাবি সরকারি তালিকায় রয়েছে, যা গত বছরই করা হয়েছিল। উদাহরণ দিয়ে শিল্পমহল বলছে, জাতীয় সড়ক এবং জলপথ পরিবহণের ক্ষেত্রে যে মোট ৪৭ হাজার কোটি টাকা লগ্নির দাবি করা হয়েছে, তার সবটাই আসবে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে। তার মধ্যে ‘ভোরসাগর’ গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৪,৪১৫ কোটি টাকা। গত সম্মেলনেই এই বন্দরে লগ্নির কথা বলা হয়েছিল।
আবার খনন ক্ষেত্রে ২৩,৩০০ কোটি টাকা লগ্নি হবে বলে এ দিন ঘোষণা করেছে রাজ্য। তার মধ্যে দেউচা-পাচামি কয়লা খনি প্রকল্পেই বরাদ্দ ২০ হাজার কোটি টাকা। সেই প্রকল্প এখন পরিকল্পনা স্তরেই পড়ে এবং গত বারের সম্মেলনে এ বাবদ ১২ হাজার কোটি টাকা লগ্নির দাবি করা হয়েছিল। তার উপরে এই প্রকল্পের ভাগিদার ৬টি রাজ্য। ফলে পশ্চিমবঙ্গের ভাগে সব টাকা পড়বেও না। বাকি ৩,৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ৮৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে কেন্দ্রীয় সংস্থা কুদ্রেমুখ আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি।
বেসরকারি লগ্নির যে দাবি এ দিন করা হয়েছে, তার কতটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে তা নিয়েও সন্দিহান অনেকে। তাঁদের মতে, সরকারের মন রাখতে অনেক শিল্পপতিই মোটা অঙ্কের টাকা লগ্নি করার কথা বিবেচনার আশ্বাস দেন। কিন্তু সেই আশ্বাস সীমাবদ্ধ থাকে সম্মেলন মঞ্চেই। ফলে গত সম্মেলনে যে সব লগ্নি প্রস্তাব ছিল, তার অনেকটাই এ বারও ফের পেশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। যেমন, হিরানন্দানি গোষ্ঠী এলএনজি পাইপলাইন তৈরির জন্য ৩,১০০ কোটি টাকা লগ্নি করার আশ্বাস দিয়েছে বলে গত বছর দাবি করেছিল সরকার। সেই প্রকল্পের কাজ কিছুই এগোয়নি। এ বার লগ্নি প্রস্তাবের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৫,১০০ কোটি টাকা। প্যাটন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের জন্য গত বছর লগ্নি প্রস্তাব ছিল ৯৪৬ কোটি টাকা। এ বার ওই একই প্রকল্পে প্রস্তাব দেখানো হয়েছে ১,২৫০ কোটি। শুক্রবার, সম্মেলনের প্রথম দিনে হলদিয়ায় তেল শোধনাগার তৈরির ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করার কথা বলেছিলেন হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের কর্ণধার পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। এ জন্য কত টাকা লাগবে তা বলতে গোড়ায় রাজি হননি তিনি। অমিত মিত্র কার্যত তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেন যে, শোধনাগার হলে পুঁজি লাগবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ দিনের তালিকায় সেটাই লগ্নি প্রস্তাব হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে।
এটা ঠিক যে একটা শিল্প সম্মেলনে যে পরিমাণ লগ্নি নিয়ে আলোচনা হয়, তার ভগ্নাংশই শেষ পর্যন্ত বাস্তবের মুখ দেখে। প্রস্তাবের কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নির্ভর করে রাজ্যের লগ্নি টানার ক্ষমতা এবং শিল্পক্ষেত্রে তার ভাবমূর্তির উপরে। গুজরাতের মতো শিল্পোন্নত রাজ্যেও মোট লগ্নি প্রস্তাবের ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের বেশি বাস্তবায়িত হয় না। পশ্চিমবঙ্গের মতো পিছিয়ে থাকা রাজ্যে তো তার পরিমাণ আরও অনেক কম। কিন্তু মমতার সরকার লগ্নি প্রস্তাবের যে হিসেব দাখিল করে তাতে দুধের থেকে জলের পরিমাণ কয়েকশো গুণ বেশি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কংগ্রেসের প্রবীণ বিধায়ক মানস ভুঁইঞার মন্তব্য, ‘‘ভোটের দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আড়াই লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের মিথ্যা গল্প ফাঁদছেন। এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরও দাবি, ‘‘বড় বড় ফ্লেক্সে লগ্নির যে তথ্য লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।’’
বিরোধীদের আরও অভিযোগ, মমতা বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময় থেকে যে শিল্প-বিরোধী অবস্থান নিতে শুরু করেছিলেন, ক্ষমতায় আসার পরেও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। উল্টে তাঁর সরকারের জমি-নীতি এবং শাসক দলের জুলুমের জেরে নতুন শিল্প তো আসছেই না, পুরনো শিল্পেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। এই অভিযোগ স্বাভাবিক ভাবেই মানতে নারাজ তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও শুক্রবারের মতো এ দিনও তাঁর সরকারের গা থেকে শিল্পবিরোধী তকমা মুছে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছেন। শিল্পমহলকে আশ্বস্ত করতে তিনি বলেন, ‘‘সকলকে অনুরোধ করছি দয়া করে লগ্নি করুন। পশ্চিমবঙ্গ শান্তিপূর্ণ। এখানে আর বন্ধ হয় না। কোনও সমস্যা হলে যদি কেউ আমাদের কাছে আসেন, চিঠি দেন, আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে সমাধান করে দিই। আমরা শিল্পমহলকে হয়রান করতে চাই না।’’ যা শুনে সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘উনি কী ভাবে এ রাজ্য থেকে ন্যানো তাড়িয়েছেন, তা শিল্পপতিরা জানেন। ফলে শিল্প সম্মেলনে যতই কাঁদুনি গান, হাত জোড় করে ভিক্ষা করুন, তাঁরা এ রাজ্যে শিল্প করবেন না।’’
বড় শিল্পের বিহনে মুড়ি-তেলেভাজাকেও ইদানীং শিল্প হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছেন মমতা। তাই শুক্রবার যে মঞ্চ আলো করে ছিলেন মুকেশ অম্বানী, নিরঞ্জন হিরানন্দানি, সজ্জন জিন্দলের মতো দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা, শনিবার সেখানেই ঠাঁই হয় পরিবহণ এবং হাঁস-মুরগি পালন সংস্থার প্রতিনিধিদেরও। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের ভাষায় অবশ্য ‘‘পোলট্রি একটা বিরাট ব্যাপার।’’