Corruption in Health System

‘কথা না শুনলে পড়া শেষ করতে দেবে না’

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৬:৪১
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ফেল করা পড়ুয়া ‘ইউনিভার্সিটি টপার’ হয়ে যাচ্ছে! খোদ অধ্যক্ষরা সামনে আনছেন এই অভিযোগ! তাঁরা বলছেন, ‘‘সাজানো ঘটনা নয়, আদ্যোপান্ত সত্যি। এ নিয়ে অভিযোগ, গোলমাল, বিক্ষোভ কিছু কম হয়নি।’’ তার পরে? তাঁদের উত্তর, ‘‘তার পর, সব পথ এসে মিলে গেল শেষে...।’’

Advertisement

কোথায় মিলল? স্বাস্থ্য ভবনে? স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে? নাকি শিকড় আছে অন্য কোথাও? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক-পড়ুয়া তাঁর জীবনের বিনিময়ে এই প্রশ্নগুলো সামনে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি এক ঝটকায় এমন একটা দুনিয়ার পর্দা সরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, যে দুনিয়ায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়াও তাদের ‘স্যর’কে চমকায়! জেলার এক মেডিক্যাল কলেজের ডিন-এর কাছে তুই-তোকারি করে ফোন আসে, ‘‘বড্ড উড়ছিস! চাকরিটা কি করতে চাস?’’

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে এক ছাত্রী ক্লাসে আসতেনই না। এক শিক্ষক-চিকিৎসক তাঁকে বলেছিলেন, এ ভাবে চললে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া যাবে না। পরিণাম? ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাবা অধ্যক্ষের কাছে এসে জানান, তাঁর মেয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কলেজের দুই ‘দাদা’ অধ্যক্ষের ঘরে দাঁড়িয়েই মাথা নেড়ে নেড়ে বলে চললেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অনাচার তো বরদাস্ত করা যাবে না। দরকার হলে ওই শিক্ষককে বদলি করে দিতে হবে। অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ছাত্রীর সামনেই কুৎসিত ভাবে তিরস্কার করেছিলেন শিক্ষককে। সে যাত্রা কেঁদে-ককিয়ে বদলি আটকেছিলেন শিক্ষক। কিন্তু ভুলেও আর ‘শাসন’-এর পথে হাঁটেননি।

Advertisement

ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের অভিযোগ, ‘‘বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, অভীক দে-র মতো আরও কয়েক জন সৈন্য নিয়ে যে সেনাবাহিনী তৈরি হয়েছিল সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে, তাদের কাছে নির্দেশই ছিল ‘ক্যাচ দেম ইয়ং’। অর্থাৎ একেবারে কলেজে ভর্তি হওয়া মাত্র ছেলেমেয়েদের পাকড়াও করো। বুঝিয়ে দাও তোমাদের দাপট। বুঝিয়ে দাও, তালে তাল না মেলালে তারা টিকতে পারবে না।’’

কী সেই বোঝানোর ‘মেকানিজ়ম’? রাজ্যের একাধিক মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষ, শিক্ষক-চিকিৎসক, পড়ুয়াদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গিয়েছে, তা অনেকটা এ রকম: প্রথমে ক্লাস করতে বাধা দেওয়া হবে। শুধু পড়ুয়া নয়, শিক্ষকও ক্লাসে এসে‌ অনেক সময়ে দেখবেন, সেখানে অন্য কিছু চলছে। আর জি করের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের যেমন অভিজ্ঞতা, ‘‘ক্লাসে এসে অনেক দিনই শুনতে হয়েছে, ওখানে অন্য কিছু চলছে। কোনও মিটিং, কোনও অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। এক দিন গিয়ে শুনলাম, নাচের মহড়া হবে। তাই ক্লাস বাতিল। জিজ্ঞাসা করলাম, বাতিলের সিদ্ধান্তটা কার? তৃতীয় বর্ষের এক পড়ুয়া, যার বয়স আমার সন্তানের চেয়েও কম, সে বলল, ‘আমার’।’’

দিনের পর দিন ক্লাস না করে ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে যখন খারাপ নম্বর আসবে, তখন ‘দাদা’ বলবেন, ‘ভাবিস না, আমি ম্যানেজ করে নেব।’ ‘দাদা’র বাতলে দেওয়া ‘ম্যানেজ’-এর পথ অনুযায়ী প্রশ্ন কেনার পথে যদি কেউ না হাঁটে, বছর শেষের পরীক্ষায় তার ফল যদি আবার খারাপ হয়, তা হলে ‘দাদা’ ও তার বাহিনী আবার এসে প্রস্তাব দেয়। এ বার খানিকটা চড়া সুরে। আর ছেলেটি বা মেয়েটি যদি দেখেন, ক্লাস না করে, বিন্দুমাত্র পড়াশোনা না করে তাঁরই সামনে অন্য অনেকে বেশি নম্বর পেয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনিও দাদার অনুগামী হওয়ার পথেই হাঁটেন। পড়াশোনা না করে অনার্স পাওয়ার ফল এমনই যে, ক্ষতে সাধারণ সেলাই করতে বা রক্তচাপ মাপতেও হাত কাঁপে।

এই ‘দাদা’রা রীতিমতো নজির তৈরি করে রাখে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে। অভিযোগ, ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজে সেকেন্ড এমবিবিএস পরীক্ষার থার্ড সিমেস্টার দেবেন না বলে ঘোষণা করলেন পড়ুয়ারা। শিক্ষকেরা অধ্যক্ষের শরণাপন্ন হলেন, কারণ পরীক্ষা না দিলে সকলকেই ফেল করাতে হবে! অধ্যক্ষ সমস্ত পড়ুয়ার বাড়িতে চিঠি লিখে জানালেন বিষয়টা। বাড়ির লোকেরা তো আকাশ থেকে পড়লেন! পড়তে এসে ছেলেমেয়েরা যে এমন কিছু করবে, তা তাঁদের কল্পনারও অতীত। অধ্যক্ষ জানালেন, পরীক্ষা দিতেই হবে। ‘দাদা’রা জানাল, পরীক্ষা দেওয়ার মতো সময় নেই কারও। শেষ পর্যন্ত রফা হল থিয়োরি পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। শুধু প্র্যাক্টিক্যালটুকু দেওয়া হোক। দাদাদের নিয়ন্ত্রণে প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা হল। সেই নম্বরই যোগ হল থিয়োরিতে। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় সবটাই জানল। ‘দাদা’-রা পড়ুয়াদের বলল, ‘চাইলে আমার ঠিক কী কী করতে পারি, সেটা দেখলি তো!’ শুধু ডায়মন্ড হারবার নয়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক অবশ্য বলেছেন, ‘‘কিছুই তো শুনিনি কখনও। কেউ তো অভিযোগ করেনি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে কী হয়েছিল, তা অবশ্য জানি না।’’

কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, বর্তমানে এসএসকেএম হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক তনয় মহন্ত বলছিলেন, যারা পড়তে চায়, মন দিয়ে শিখতে চায়, তাদেরও এরা বাধ্য করে এদের দলে নাম লেখাতে। তাদের পড়তে দেয় না, পরীক্ষার হল-এ লিখতে পর্যন্ত দেয় না। তিনি বলেন, ‘‘এক বার দেখলাম অত্যন্ত মেধাবী এক পড়ুয়াও পরীক্ষার হল-এ বসে টুকছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী রে শেষে তুই-ও? সে বলেছিল, ‘স্যর, আমার আর কীই বা করার আছে? ওদের কথা না শুনলে, ওরা আমার পড়া শেষ করতে দেবে না। বাবা-মা অনেক কষ্ট করে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছেন। মাঝপথে তো ফিরে যেতে পারব না। তা হলে বাবা-মা মরে যাবে।’’

ওই পড়ুয়া উপায়ান্তর না দেখে ওই স্রোতে গা ভাসিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। কিন্তু সকলে তা পেরে ওঠে না। অভিযোগ, ওই কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজেরই এক পড়ুয়া, যাঁর বাড়ি বর্ধমানে, দু’বছর আগে এই টোকাটুকি-সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। হাসপাতাল সূত্রে খবর, মেয়ের মৃত্যুর পর বাবা এসে অধ্যক্ষকে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে খুব কাঁদত আর বলত, ক্লাস না করে, পড়াশোনা না করে স্রেফ প্রশ্ন কিনে, টুকে লিখে অনেকে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে যাচ্ছে। আর আমি নিজের মতো করে চেষ্টা করেও তাদের থেকে পিছিয়ে পড়ছি। দিনের পর দিন এটা আমি আর মেনে নিতে পারছি না।’ এ কথা শুনে অধ্যক্ষ কী বলেছিলেন? সেই দিন ওই ঘরে উপস্থিত এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অধ্যক্ষ বলেছিলেন, ‘কী মুশকিল, এত অল্পবয়সী মেয়ে, মানসিক ভাবে এত দুর্বল হলে কী ভাবে চলবে?’’’

মানসিক ভাবে শক্ত হলে কিন্তু অন্য দাওয়াই। নানা রকম জোর খাটিয়েও যে পড়ুয়াদের বাগে আনা যায় না, তাদের জন্য রয়েছে ফেল করানোর ব্যবস্থা। অভিযোগ, অভীক অ্যান্ড বিরূপাক্ষ কোম্পানির কাছে পাশ করাতে হবে, অনার্স নম্বর দিতে হবে— এমন পড়ুয়াদের পাশাপাশি কাদের কাদের ফেল করাতে হবে, সেই তালিকাও থাকত। শিক্ষক-চিকিৎসকদের উপরে জোর খাটানো হত ওই পড়ুয়াদের নম্বর কমিয়ে দেওয়ার জন্য। বারাসত মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমার কাছে এমন প্রস্তাব এসেছিল। আমি বলেছিলাম, কয়েক নম্বর বাড়িয়ে কাউকে পাশ করিয়ে দিতে পারব। কিন্তু পাশ করা ছাত্রকে ফেল করাতে পারব না। এ কথা বলার জন্য প্রচুর চাপের মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে।’’

চাপের নানা রকমফের আছে। পুরুষ চিকিৎসকদের জন্য এক রকম দাওয়াই। মহিলাদের জন্য আর এক রকম। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এক মহিলা শিক্ষক-চিকিৎসক বেশ কি‌ছু আর্থিক দুর্নীতি ধরে ফেলেছিলেন বলে অভিযোগ। ওই প্রধানকে ‘টাইট’ দিতে বদলি করা হয় কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজে। অধুনা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে কোচবিহার হল গ্যারাজ পোস্টিং-এর অন্যতম জায়গা। কোচবিহার থেকে ছুটিতে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন যখন তিনি, রাতের ট্রেনে এক দল গুন্ডা তাঁকে আক্রমণ করে বলে অভিযোগ। বহু কষ্টে তিনি রক্ষা পান।

প্রশ্ন উঠেছে, আর জি করের ওই তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়াও কি কোনও স্তরে কোনও দুর্নীতি ধরে ফেলেছিলেন? তাঁকেও কি এমন কোনও চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল? জেনে যাওয়ার কারণেই কি তাঁর এমন পরিণতি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement