কেউ জমিবাড়ি নিয়ে শরিকি বিবাদ মেটাতে আদালতে গিয়েও বিচার পাচ্ছেন না।
কেউ প্রতারিত হয়ে বিচার চাইতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরছেন।
উচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার কারও ঘুম উড়েছে।
আইনজীবীদের লাগাতার বয়কটের ফলে শ্রীরামপুর দেওয়ানি আদালতে (সিনিয়র ডিভিশন) মন্দাক্রান্তা সাহার এজলাসে যে কোনও কাজই হচ্ছে না!
বিচারক যে নিজেই শুনানি প্রক্রিয়া চালাবেন, সে উপায়ও নেই। কারণ, কেউ সাক্ষ্য দিতে এলে আইনজীবীদের বিক্ষোভের জেরে তা-ও পণ্ড হচ্ছে। তিন সপ্তাহেরও বেশি ধরে ওই এজলাসে অচলাবস্থায় বিচারপ্রার্থীদের হয়রানির শেষ নেই। রোজই তাঁরা আসছেন। রোজই বিচার না পেয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হচ্ছে। অচলাবস্থা কবে কাটবে, সে ইঙ্গিতও মিলছে না। জমছে মামলার পাহাড়। এর প্রভাব পড়ছে আদালতের অন্যত্রও।
গত ৭ জানুয়ারি আদালতের প্রবীণ আইনজীবী রামচন্দ্র ঘোষের একটি মামলার শুনানি পরে শুনবেন বলেন মন্দাক্রান্তাদেবী। তার পরেই ওই বিচারকের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের অনেকে খড়্গহস্ত হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ। মন্দাক্রান্তাদেবীর বিরুদ্ধে দুর্বব্যহারের অভিযোগ তুলে সে দিন থেকেই তাঁর এজলাস বয়কট শুরু করে দেন আইনজীবীরা।
আইনজীবীদের এই আন্দোলনে বিরক্ত সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের অনেকেই। যেমন, কোন্নগরের সত্যপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। জমিবাড়ি নিয়ে শরিকি বিবাদে হয়রান হয়ে তিনি আদালতরে দ্বারস্থ হন। ২০১১ থেকে তাঁর মামলা চলছিল ওই আদালতে। ধাক্কা খেল গত ৭ জানুয়ারি। তাঁর কথায়, “এর আগে মামলার তারিখই পেতাম না। এখন পাচ্ছিলাম। কিন্তু আইনজীবীদের কী সব ঝামেলা হওয়ায় বিপদে পড়ে গিয়েছি। আমাদের কথা কিন্তু আইনজীবীদের ভাবা উচিত।”
শ্রীরামপুরে এক সেবা-ট্রাস্টের ঘর দখল সংক্রান্ত মামলাও ওই এজলাসে চলছে। শুনানির জন্য ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান শ্যামল মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু দিন ধরেই আদালতে ঘুরছেন। কিন্তু শুনানি হচ্ছে কই! তাঁরও ক্ষোভ, “বিচারকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলে তা প্রকাশের মাধ্যম কি সাধারণ মানুষকে হয়রান করা? আমরা তো আইনজীবীকে টাকা দিয়ে বিচার পেতে যাই। ওঁদের আন্দোলনের শিকার সাধারণ মানুষ কেন হবেন?”
বয়কট শুরুর দিন মন্দাক্রান্তাদেবীর এজলাসে এসেছিলেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। বধূ নির্যাতনের মামলায় তিনি অভিযুক্ত। তিনিও পুত্রবধূর বাপেরবাড়ির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেছেন। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তাঁর কথায়, “আইনজীবীরা কি নিজেদের কথা ছাড়া আর কিছুই ভাববেন না? প্রতিবাদ কি অন্য ভাবে হয় না?”
মন্দাক্রান্তাদেবীর আদালতে গড়ে প্রতিদিন ৩০-৩৫টি মামলার শুনানি হত। কিন্তু শুনানি বন্ধ থাকায় সে সবই জমে রয়েছে। তার উপরে আইনজীবীদের বয়কটে ব্যাহত হচ্ছে অন্য আদালতের কাজও। এ জন্য বিচারপ্রার্থীদের কেউ কেউ আইনজীবীদের বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগও তুলছেন।
বুধবারেই আচমকা গোটা আদালতে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন আইনজীবীরা। ফলে, বহু মানুষকে ফিরে যেতে হয়। বিমল চক্রবর্তী নামে শেওড়াফুলির এক বৃদ্ধ তাঁর মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের মামলা করেছেন। সেই মামলায় অন্য একটি এজলাসে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, “বিচারক এজলাসে উঠেছিলেন। হঠাৎ আইনজীবীরা সেখানে ঢুকে কাজ বন্ধের কথা জানান। সব পণ্ড হল। শুনানির তারিখ তিন মাস পিছোল। ওঁদের জন্য আমাদের এমন সমস্যা কেন হবে?” একই রকম ক্ষোভ আরও অনেকের।
তবে বিক্ষোভরত আইনজীবীরা নিজেদের অবস্থান থেকে সরছেন না। তাঁরা মন্দাক্রান্তাদেবীর বদলির দাবিতে অনড়। বিক্ষোভকারীদের পক্ষে শ্রীরামপুর আদালতের বার লাইব্রেরির সম্পাদক রামচন্দ্র ঘোষ বলেন, “আপনারা পুরোটাই বিকৃত খবর পরিবেশন করছেন। কিন্তু গোটা বিষয়টির তদন্ত হবে। তাতেই প্রকৃত সত্য উঠে আসবে।”