বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসাবে সরকারিভাবেই চিহ্নিত আরামবাগ মহকুমা। প্রতি বছর বর্ষায় ডিভিসি জল ছাড়লেই চাষ-সহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকেন মহকুমার মানুুষ।
এ বার গত কয়েক দিনের বৃষ্টির জেরে শনিবার সকালে ডিভিসি ৭৩ হাজার কিউসেক জল ছাড়ায় ফের আতঙ্কে মহকুমার বিস্তীর্ণ লোকজন। ওই জল ছাড়ার ফলে রবিবার থেকেই মহকুমার দামোদর এবং মুন্ডেশ্বরী নদীর জল বাড়তে শুরু করেছে।
নদীর জল বাড়ায় যখন বন্যার ভ্রূকুটি, তখন মহকুমার ৬টি ব্লকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৫টি ব্লকেই বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিকদের পদ শূন্য রয়েছে। ফলে বিশেষজ্ঞ ছাড়াই বিপর্যয় মোকাবিলা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে আরামবাগ মহকুমার ব্লক প্রশাসনগুলিকে। অন্যান্য দফতরের অনভিজ্ঞ কর্মীদের সংগ্রহ করা তথ্যের উপর ভরসা করেই বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি এবং তা বাস্তবায়িত করা আদৌ যুক্তিযুক্ত ও পরিস্থিতির উপযোগী হবে কি না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিডিওরা সন্দিহান। ব্লকগুলিতে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরে অনুমোদিত পদে একজন আধিকারিক তথা ব্লক ডিজার্স্টাস ম্যানেজমেন্ট অফিসার-সহ ৪ জন করে কর্মীর থাকার কথা। কিন্তু মহকুমার ৬টি ব্লকের মধ্যে ৫টি ব্লক (খানাকুল-১ ও ২, পুড়শুড়া, আরামবাগ এবং গোঘাট-১) অতিপ্লাবিত চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কোনও আধিকারিকই নেই। শুধুমাত্র একজন করে করনিক আছেন। অন্যদিকে, যেখানে বন্যার ভ্রূকুটি নেই, সেই গোঘাট-২ ব্লকে একজন আধিকারিক নিয়োগে করা হয়েছে। এক কথায় বন্যা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এ হেন অবস্থায় মহকুমা প্রশাসন দিশাহারা। মহকুমা শাসক প্রতুল কুমার বসু বিশেষজ্ঞ কর্মীর অভাবে সংশ্লিষ্ট দফতরের অসুবিধার কথা স্বীকার করে বলেন, “ প্রাথমিক ভাবে অন্য দফতরের অফিসারদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে কাজ সামাল দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের মাথার উপর থাকছেন বিডিওরা।” যদিও বিডিওদের বক্তব্য, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মী জরুরি। অন্য দফতরের কর্মীদের সেই অভিজ্ঞতা না থাকায় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কাজ যে সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য।
তা ছাড়া, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে যাঁদের আনা হয়েছে সেই আধিকারিকদের অনেকেই জানিয়েছেন, সরেজমিনে তদন্ত করে যে সব তথ্য সংগ্রহ করার কথা তা জোড়াতালি দিয়ে সে সব কাজ সামলানো ছাড়া উপায় নেই। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরনো কয়েক বছরের নথি তথ্য সাজাতে হচ্ছে। যাতে ভুলভ্রান্তি থানার সম্ভাবনা প্রচুর।
মহকুমার বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এই হাল নিয়ে হুগলির জেলা সভাধিপতি মেহবুব রহমান বলেন, “সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মীর অভাব কাটিয়ে উঠে যাতে যথাযথ পরিষেবা দেওয়া যায় সে জন্য পঞ্চায়েত স্তর জেলা প্রশাসন সজাগ রয়েছে।”
অতিরিক্তি জেলাশাসক (উন্নয়ন) আবিদ হোসেন বলেন, “সমস্যার সমাধানে ইতিমধ্যেই খানাকুল-২ ব্লকে একজন আধিকারিককে পাঠানো হচ্ছে। খুব শীঘ্রই খানাকুল-১ ব্লকেও একজন আধিকরিককে পাঠানো হবে। ক্রমে সব ব্লকেই তা কার্যকর করা হবে।”
যে কোন বিপর্যয়ের আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি কমানোর জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়া, পরিস্থতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কাজ। বন্যার ক্ষেত্রে যে সব তথ্য এই দফতরে থাকার কথা তা হল, বিভিন্ন নদী বাঁধ কোথায় কি অবস্থায় তার সরেজমিন তদন্ত করে চিহ্নিত করা, প্রয়োজনীয় খাদ্য-ওষুধপত্র সহ বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী এবং অত্যাবশকীয় পণ্য ব্লক এবং পঞ্চায়েত স্তরে মজুত রাখার ব্যবস্থা, স্থানীয় নৌকা এবং মাঝির তথ্য রাখা, বেতারে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করা, কন্ট্রোলরুম চালু করা ইত্যাদি। এ ছাড়াও বন্যার সময় এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে কী কী করণীয় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
আরামবাগ মহকুমার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে বন্যাপ্রবণ প্রধান তিন তিনটি নদী দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর। এ ছাড়াও রয়েছে রূপনারায়ণ, আমোদর, হরিণাখালি, তারাজুলি, সিঙ্গার, কানা দ্বারকেশ্বর, হরহরা, আকবরী, রামপুর ইত্যাদি বেশ কিছু নদী ও খাল। বর্ষায় ডিভিসি, মাইথন, পাঞ্চেত ও কংসাবতী ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ার ফলে প্রায় প্রতি বছর আরামবাগের একটি বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। মহকুমার ছ’টি ব্লকের ৬৩টা পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫৩টি বন্যা কবলিত। ২০০৯ সালের বন্যায় রেকর্ড সংখ্যক মোট ১৮১টি জায়গায় বাঁধ ভাঙে। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে দফায় দফায় এই সব বাঁধের সংস্কার হলেও নতুন করে ১৫০টি জায়গা দুর্বল বলে আপাতত চিহ্নিত করা হয়েছে বলে ব্লক প্রশাসনগুলি সূত্রে জানা গিয়েছে।