একদিকে সেচ বিভাগ অন্যদিকে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, সরকারি দুই বিভাগের সমন্বয়ের অভাবে আরামবাগ মহকুমায় নদী বাঁধ মেরামতের কাজে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
নদী বাঁধ সেচ দফতরের সম্পত্তি। পঞ্চায়েত-পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ সেখানে কাজ করতে গেলে সেচ দফতরের কাছে কারিগরি অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বিডিওদের অভিযোগ সেই অনুমোদন পেতে তাঁদের কালঘাম ছুটে যায়। আড়াই থেকে তিন বছর লেগে গিয়েছে এরকম নমুনা রয়েছে অনেক। অগত্যা আইন না মেনেই বেশ কিছু প্রকল্পে ‘জরুরি ভিত্তি’তে কাজ করতে হয়। সেই জরুরি ভিত্তির তকমায় কাজটা আটকানো হয় না ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে বছরভর অসন্তোষ এবং চাপান-উতোর চলতেই থাকে দুই বিভাগের আধিকারিকদের। এই কারিগরি অনুমোদন সংক্রান্ত সমস্যাই নদীবাঁধ মেরামত ত্বরান্বিত করার মূল বাধা বলে জেলা প্রশাসনেরও অভিযোগ। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানেরও কোনও পথ পাওয়া যায়নি বলে পঞ্চায়েত স্তরে অনুযোগ।
তড়িঘড়ি নদী বাঁধ মেরামতের ক্ষেত্রে প্রকল্পের খরচ অনুপাতে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত স্তরে যে কারিগরি অনুমোদন দেওয়ার আপৎকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হত, ওই দফতরগুলির তার এক্তিয়ার নেই বলে কড়াভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সেচ দফতরের তরফে। জেলা সেচ দফতরের একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ভাস্বরসূর্য মন্ডল বলেন, “বাঁধ মেরামতের কাজটা পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ করলেও সেচ দফতরের কারিগরি অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। আমার চাই তাঁরা কোনও বাঁধ মেরামতের প্রকল্প রূপায়ণের আগে আমাদের বিশেজ্ঞদের কাছে কারিগরি অনুমোদন নিন। কারিগরী অনুমোদন দেওয়ার আগে নদীর গতিপথ, জলের স্রোত ইত্যাদি নানা বিষয় খতিয়ে দেখেন বিশেষজ্ঞরা।”
কারিগরি অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বের অভিযোগ ভাস্বরসূর্যবাবু মানতে চাননি। কারিগরি অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রে তা হলে বিশেষ নির্দেশিকা দেওয়া হচ্ছে না কেন?
একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “আইনগত অধিকারে নদীবাঁধ সেচ দফতরের। ফলে আলাদা নির্দেশিকার দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। অন্যদিকে অতিরিক্ত জেলা শাসক (জেলা পরিষদ) সুমন ঘোষ বলেন, “নদীবাঁধ সেচ দফতরের সম্পত্তি। কারিগরি অনুমোদন দেওয়ার আধিকারী তাঁরাই। কিন্তু সেই অনুমোদন যথাসময়ে পাওয়া নিয়ে যে সমস্যা হয়, তা অনেক সময় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উভয় তরফেই সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ করা হয়েছে।”
বাঁধ মেরামতের ক্ষেত্রে সেচ দফতরের কারিগরি অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে কি ভাবে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করার চল আছে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের?
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নদীবাঁধ মেরামতে মাটির কাজের ক্ষেত্রে প্রকল্পটি ৩ লক্ষ টাকার মধ্যে থাকলে পঞ্চায়েতর নির্মাণ সহায়ক কারিগরি অনুমোদন দেন। প্রকল্পটির খরচ সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা ছাড়ালে সেই কাজের কারিগরি অনুমোদন দেবেন ব্লক ইঞ্জিনিয়াররা। ৮ লক্ষের উপর হলে জেলা পরিষদের সহকারী বাস্তুকার এবং প্রকল্পটি ৪৫ লক্ষ টাকার মধ্যে থাকলে একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। তারও বেশি ২ কোটি টাকা পর্যন্ত কারিগরি অনুমোদন দেওয়ার অধিকারী সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। ব্লক স্তরের বাস্তুকারদের অভিযোগ, নানা প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু বছরের পর বছর সেগুলি পড়েই থাকে। সেচ দফতরের কাছে কারিগরী অনুমোদন নেওয়া মানে সময় দীর্ঘায়িত হওয়া। আরামবাগের বিডিও প্রণব সাঙ্গুই এমনই উদাহরণ দিয়ে জানান, আরামবাগের লঘুচক পটির বাঁধ মেরামত নিয়ে প্রায় তিন বছর ঘোরার পর শেষ পর্যন্ত গত ২ জুন কারিগরি অনুমোদন মিলেছে। একইরকম ভাবে সেচ দফতরের কারিগরি অনুমোদন দেওয়া নিয়ে গাফিলতি এবং হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন পুড়শুড়ার বিডিও অনির্বাণ রায়, খানাকুল ১ ও ২-এর বিডিও যথাক্রমে গোবিন্দ হালদার এবং অনুপকুমার মণ্ডল।
আরামবাগ মহকুমার ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেচ দফতরের দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁসে অন্তত ২০টি নদী বাঁধের ভাঙন ২০০৯ সাল থেকে মেরামত হয়নি। সেগুলি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ থেকে কারিগরি অনুমোদন নিয়ে ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করে কোনওরকমে প্লাবন সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
আরামবাগ মহকুমার নদী বাঁধগুলির ভাঙনপ্রবণ এলাকা অনেক। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে এলাকাগুলি তার অন্যতম আরামবাগের আরান্ডি ২ পঞ্চায়েতের মুণ্ডেশ্বরী নদীর লঘুচক পটি সংলগ্ন বাঁধ। গত তিন বছর ধরে কারিগরি আনুমোদনের অপেক্ষার পর অবশেষে তা মিলেছে গত ২ জুন। সেখানে ৫০০ মিটার ঝুরো মাটি দিয়ে তাপ্পিমারা অংশটির মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ ১৯৫ মিটার এলাকার জন্য ৩৬ লক্ষ ২১ হাজার টাকার প্রকল্পের কারিগরি অনুমোদন দিয়েছে সেচ দফতর।
বিলম্বের কথা অস্বীকার করে ভাস্বরসূর্যবাবু বলেন, “আমি বিষয়টি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনুমোদন দিয়েছি।” আরামবাগ মহকুমার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বর, দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী এবং রূপনারায়ণ। বর্ষায় ডিভিসি, মাইথন, পাঞ্চেত ও কংসাবতী ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ায় প্লাবিত হয় ওই সব নদী সংলগ্ন এলাকা। মহকুমার ৬৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫৩টিই বন্যা কবলিত। নদী বাঁধগুলির মধ্যে সরাসরি সেচ দপ্তরের অধীন আছে ৯৮.৫ কিলোমিটার। সেই অংশে তাঁরাই মেরামত বা সংস্কারের কাজ করেন। বাদবাকি পঞ্চায়েত সমিতি এবং পঞ্চায়েত মিলিয়ে দেখভাল করে আসছে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার অংশ।
সেচ দফতরের কারিগরি অনুমোদন না নিয়েই প্রকল্পের খরচের অঙ্ক অনুপাতে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ইঞ্জিনিয়াররাই ওই অংশের কাজের অনুমোদন দিয়ে আসছেন। জানা যায়, ২০০৯ সালের বন্যায় রেকর্ড সংখ্যক বাঁধ ভাঙে মোট ১৮১টি জায়গায়। দুর্বল জায়গা বলে চিহ্নিত হয় কমপক্ষে ১৫০টি জায়গা। সেই সব ক্ষতেরই মেরামত সম্পূর্ণ হয়নি বলে বিভিন্ন বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষের অভিযোগ।