শ্রীরামপুর

পঞ্চানন কর্মকারকে ভুলেছে শ্রীরামপুর

শতাব্দী-প্রাচীন বাড়িটার পাঁচিলের ওপারে এখন বাস দাঁড়ায়। শ্রীরামপুর শহরে কোনও স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড নেই। তাই শ্রীরামপুর আদালতের সামনে বাস দাঁড়াবার অস্থায়ী ঠিকানা ওই পুরনো চৌহদ্দিটাই। সামনে গিয়ে ঠাহর করলে দেখা যায়, মরচে-ধরা, ভাঙা লোহার রেলিং, নোনা-ধরা নোংরা পাঁচিল। সর্বত্র অযত্নের ছাপ। পাঁচিলটা ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, প্রায় আবছা হয়ে আসা বিবর্ণ আঁকিবুঁকি। বুনো লতাপাতা সেই সব নকশা আড়াল করতে চাইছে।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৩২
Share:

ড্যানিস প্রশাসনিক ভবন এখন যে অবস্থায় (বাঁদিকে)। ডানদিকে, অতীতের সাক্ষী সেন্ট ওলাফ গির্জার সামনে কামান। ছবি: দীপঙ্কর দে।

শতাব্দী-প্রাচীন বাড়িটার পাঁচিলের ওপারে এখন বাস দাঁড়ায়। শ্রীরামপুর শহরে কোনও স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড নেই। তাই শ্রীরামপুর আদালতের সামনে বাস দাঁড়াবার অস্থায়ী ঠিকানা ওই পুরনো চৌহদ্দিটাই। সামনে গিয়ে ঠাহর করলে দেখা যায়, মরচে-ধরা, ভাঙা লোহার রেলিং, নোনা-ধরা নোংরা পাঁচিল। সর্বত্র অযত্নের ছাপ। পাঁচিলটা ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, প্রায় আবছা হয়ে আসা বিবর্ণ আঁকিবুঁকি। বুনো লতাপাতা সেই সব নকশা আড়াল করতে চাইছে।

Advertisement

অথচ দুই দশক আগে এখানকার ছবিটা একেবারেই ভিন্ন ছিল। ওই পাঁচিলের সামনে মানুষের জটলা থাকত। কারণ ওই পাঁচিলটায় অনেকটা চালচিত্রের আদলে প্লাস্টার করে নেওয়া হয়েছিল। তারপর সেই প্লাস্টার রাঙিয়ে নেওয়া হয়েছিল নানা রঙে। তারপর সেখানে আঁকা হয়েছিল শ্রীরামপুরের ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাসের বিবরণ।

শ্রীরামপুর একসময় ছিল বাংলার শিক্ষা, সাহিত্যে অগ্রণী। প্রাচীন বাড়িটির পাঁচিলের গায়ে চিত্রিত করা হয়েছিল শহরের সেই ইতিহাস। শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো হয়েছিল সেই সব ছবি। এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখনকার মহকুমাশাসক শমিষ্ঠা ঘোষ। তিনি অন্যত্র বদলি হতে সেই ধারাবাহিকতা আর রক্ষিত হয়নি।

Advertisement

প্রাচীন বাড়িটি নিজেই জীবন্ত ইতিহাস। ১৭৫৫ সালে শ্রীরামপুরে তৈরি গঙ্গাতীরের এই বাসভবনটি ছিল ড্যানিশ (ডেনমার্কের বাসিন্দা) শাসনকালে গভর্নরের আবাস। এখন সেখানে মহকুমাশাসকের আবাস।

ইতিহাসের বহু নিদর্শন অবশ্য আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর শহরে হাজির হলেন। তৈরি হল ছাপাখানা। শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে নারী শিক্ষার প্রসারে বই ছাপা হল। বাংলা অক্ষর তৈরি করা হল পঞ্চানন কর্মকারকে দিয়ে। তিনি বাংলা অক্ষর তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সীসা দিয়ে বাংলা অক্ষর তৈরি হল। মিশনারি সাহেবদের চেষ্টায় রামায়ণ, মহাভারত বাংলায় অনুবাদ হল। কেরি সাহেব নিজে করলেন বাইবেলের বাংলা অনুবাদ, তা ছাড়াও ‘হিতোপদেশ’ এবং ‘কথোপকথন’ নামে দু’টি বই। ১৮১৮ সালে তাঁর সম্পাদনায় ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হল। সেটি ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দ্বিতীয় পত্রিকা। আজ কিন্তু আর সেই ছাপাখানার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। এমনকী, কোথায় সেটি ছিল, তার কোনও স্থান নির্দেশক ফলকও কোথাও নেই।

আবার রয়ে গিয়েছে অনেক কিছুই। যেমন শ্রীরামপুর কলেজ। সেই ভবনের জায়গাটি দান করেন সেই সময় দিনেমার শাসনকর্তা। সেই সময় কলেজ তৈরি করতে খরচ হয়েছিল আড়াই লক্ষ টাকা। গঙ্গার তীরে দেড়শো বছরেরও বেশি পুরোন ভবনটি আজও শ্রীরামপুরের অক্ষয় সম্পদ। এশিয়ার মধ্যে শ্রীরামপুর কলেজ প্রথম ডিগ্রি দেওয়ার অধিকার লাভ করে।

এই কলেজের গঠনশৈলী আজও বিস্ময়ের। উইলিয়াম কেরি তাঁর অর্জিত অর্থ অনেকটাই খরচ করেছিলেন শ্রীরামপুর কলেজ তৈরির কাজে। তাঁর যে বইয়ের সংগ্রহশালা ছিল তাও তিনি দান করেছিলেন শ্রীরামপুর কলেজকে। সে সবই এখনও দেখা যায়। শ্রীরামপুর কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বাংলা নবজাগরণে কেরি সাহেবের ভূমিকার ইতিহাস অনেকটাই সংরক্ষিত।

এরপর দিনেমারদের আমলে শ্রীরামপুর শহরে তৈরি হল কারাগার। আদালত। সেন্ট ওলাফের চার্চ। ১৮০৫ সালে সেন্ট ওলেভের স্মৃতিতে নিমির্ত হয় একটি গীর্জা। সেই গীর্জার চূড়ায় রয়েছে পৃথিবীর গোলক আর পবিত্র ক্রুশচিহ্ন। গিজার্র চূড়ায় একটি ঘড়ি ছিল।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় শ্রীরামপুরে পঞ্চানন কর্মকারের হাত ধরে বাংলা মুদ্রণ যুগের সূচনা হলেও সেই ইতিহাস রক্ষিত হয়নি। পঞ্চানন কর্মকারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়েই অনায়ানেই তৈরি করা যেত একটি সংগ্রহশালা। হয়নি তাও। রাজ্য সরকার বা কোনও তরফেই কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। তার ফলে এই প্রজন্মের তরুণদের জানার কোনও সুযোগ নেই মুদ্রণ ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা।

শ্রীরামপুর এক সম্য়ে শেওড়াফুলির রাজা মনোহর চন্দ্র রায়ের অধীনে ছিল। তিনি সেখানে শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপরে নামকরণ করেন শ্রীরামপুর। শেওড়াফুলির জমিদারির অংশ হিসেবে শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি গ্রাম। মাহেশে জগন্নাথের মন্দির, চাতরায় গৌরাঙ্গদেবের মন্দির, বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থ ঘাট, বল্লভজীর মন্দির নির্মান করেন নয়নচাঁদ মল্লিক। শ্রীরামপুরের এই সমস্ত দর্শনীয় স্থান নিয়ে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে অনায়াসেই জায়গা করে নিতে পারত এই প্রাচীন শহর। তা হয়নি বলে আক্ষেপ রয়েছে শহরের প্রবীণদের। যদিও সম্প্রতি ডেনমার্কের সরকারের উদ্যোগে শ্রীরামপুরের ভেঙে-পড়া প্রাচীন প্রশাসনিক ভবনটিকে সারিয়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

শ্রীরামপুরের ইতিহাস নিয়ে বই লিখেছিলেন এক সময় এই শহরের প্রশাসক শর্মিষ্ঠা ঘোষ। তিনি বলেন, “সময়ের চাহিদায় বর্তমানে যে নগরায়নের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে সেটা অনিবার্য। কিন্তু এর পাশাপাশি ইতিহাস সুরক্ষিত থাকলে আরও ভাল হত।”

(শেষ)

কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-শ্রীরামপুর’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement