প্রশাসনের পাকা সেতু দূরঅস্ত, কুলিয়ায় ঘাটমালিকের তৈরি বাঁশের সেতুই উপায়

গ্রামবাসীরা চেয়েছিলেন পাকা সেতু। তার শিলান্যাসও হয়। তবে পাকা সেতু আর হয়নি। বদলে শিলান্যাসের আট বছর পরে গ্রামবাসীরা পেলেন বাঁশের সাঁকো। তবে তা প্রশাসনের সৌজন্যে নয়। সমস্যার কথা ভেবে নিজেই এগিয়ে এসে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ওই সেতু বানিয়ে দিয়েছেন এলাকায় খেয়া পারাপারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঘাটমালিক নিজেই। ‘নাকের বদলে নরুণ’ হলেও পারাপারের সুবিধা হওয়ায় একে স্বাগত জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

জয়পুর শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৪
Share:

মুণ্ডেশ্বরীর উপরে তৈরি সেই বাঁশের সেতু। ছবি: সুব্রত জানা।

গ্রামবাসীরা চেয়েছিলেন পাকা সেতু। তার শিলান্যাসও হয়। তবে পাকা সেতু আর হয়নি। বদলে শিলান্যাসের আট বছর পরে গ্রামবাসীরা পেলেন বাঁশের সাঁকো। তবে তা প্রশাসনের সৌজন্যে নয়। সমস্যার কথা ভেবে নিজেই এগিয়ে এসে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ওই সেতু বানিয়ে দিয়েছেন এলাকায় খেয়া পারাপারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঘাটমালিক নিজেই। ‘নাকের বদলে নরুণ’ হলেও পারাপারের সুবিধা হওয়ায় একে স্বাগত জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

Advertisement

দ্বীপ অঞ্চল বলে পরিচিত হাওড়ার জয়পুরের ভাটোরা এবং ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান এই দুই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মানুষ কুলিয়ায় মুণ্ডেশ্বরী নদীর উপরে পাকা সেতুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। ২০০৬ সালে পাকা সেতুর শিলান্যাস হলেও টাকার অভাবে কাজ এগোয়নি। বহুবার এ নিয়ে এলাকাবাসী দরবার করলেও ফল মেলেনি। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেন খেয়া পারাপারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঘাটমালিক শেখ লালচাঁদ। পঞ্চায়েতের অনুমতি নিয়ে মুণ্ডেশ্বরীর উপরে তিনি বানিয়ে দিয়েছেন বাঁশের সেতু। গত বুধবার থেকে গ্রামবাসীদের যাতায়াতের জন্য ওই সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও আগামী ১ জানুয়ারি সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে বলেও ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান গ্রাম পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে।

মুণ্ডেশ্বরী এবং রূপনারায়ণ বেষ্টিত এই দ্বীপ এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বর্তমানে নৌকায় করে তাঁদের নদী পার হয়ে জেলার বাকি অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময় নদীতে পর্যাপ্ত জল না থাকায় নৌকা চলে না। তখন হাঁটুজল ভেঙে নদী পার হয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতে মহিলা-শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সমস্যায় পড়েন। সেতু না থাকায় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। বছরপাঁচেক আগে এখানে তোলাবাজ এবং সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য এত বাড়ে যে পুলিশ ভাটোরা গ্রামে একটি তদন্তকেন্দ্র তৈরি করতে বাধ্য হয়। তদন্তকেন্দ্র উদ্বোধন করতে এসে তৎকালীন রাজ্য পুলিশের কর্তারা সাফ জানিয়েছিলেন, পাকা সেতু গড়ে দ্বীপ এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারলে পুলিশের পক্ষে পুরোদস্তুর ক্ষমতা নিয়ে কাজ করা মুশকিল। কারণ, বাড়তি বাহিনী আনার প্রয়োজন হলে পুলিশের ভরসা নৌকা। ফলে পুলিশ এসে পৌঁছনোর আগেই পালিয়ে যাবে দুষ্কৃতীরা। আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি সমস্যা দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েও। সেতুর সমস্যার কারণে ভাটোরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্থায়ী চিকিৎসক পাঠানো যাচ্ছে না। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, সেতু এবং রাস্তার অভাবে এখানে চিকিৎসকেরা আসতে চাইছেন না।

Advertisement

২০০৬ সালে বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত কুলিয়া ঘাটে সেতুর শিলান্যাস করেন। হাওড়া জেলা পরিষদকে সেতু তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেলা পরিষদ সেতুটি তৈরির পরিকল্পনা করেছিল নাবার্ড থেকে ঋণ নিয়ে। কিন্তু নাবার্ড এই প্রকল্পে যে টাকা ঋণ দিতে রাজি হয় (প্রায় ৯ কোটি টাকা) তাতে সেতু নির্মাণে রাজি হয়নি কোনও ঠিকাদার সংস্থা। তিন বার টেন্ডার দেওয়া হলেও কেউ এগিয়ে আসেনি।

২০১৩ সালে জেলা পরিষদে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। ফের সেতুর জন্য নতুন করে প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরি করে। জেলা পরিষদ সূত্রের খবর, ডিপিআর-এ দেখা যায় সেতু তৈরির জন্য অন্তত ২৫ কোটি টাকা লাগবে। এর পরেই জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সেতু তৈরির পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। ঠিক হয়, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরকে জেলা পরিষদ অনুরোধ করবে যাতে তারা পূর্ত (সড়ক) দফতরের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠায় সেতুটি তৈরির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। জেলা পরিষদের এক কর্তা জানান, টাকা এবং পরিকাঠামো দু’দিক দিয়েই রাজ্য পূর্ত (সড়ক) বিভাগ এই সেতু তৈরির জন্য উপযুক্ত। কিন্তু প্রায় ৬ মাস আগে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের কাছে এই প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের সমস্যা মেটাতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় ঘাটমালিক শেখ লালচাঁদ। ঘাটটি প্রতি বছর ইজারা দেয় ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান গ্রাম পঞ্চায়েত। লালচাঁদ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে প্রস্তাব দেন তিনি একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে নেবেন। পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে তাঁকে যেন অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি পেয়ে যান লালচাঁদ। প্রায় সাত লক্ষ টাকা খরচ করে তিনি সাঁকোটি তৈরি করেন। তবে সাঁকোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পারাপারকারীদের কাছ থেকে ২ টাকা করে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন লালচাঁদ। পঞ্চায়েত প্রধান সাবিনা বেগম বলেন, “পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে তো আর কোটি কোটি টাকা খরচ করে পাকা সেতু তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই লালচাঁদ বাঁশের সাঁকো তৈরির অনুমতি চাওয়ায় তাঁকে তা দেওয়া হয়েছে। মানুষের কিছুটা তো উপকার হবে।”

পাকা সেতুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন এমনই একজন হারুন রশিদ বলেন, “মানুষ কিছুটা হলেও উপকার পাবেন এটা সত্যি। কিন্তু পাকা সেতুর বিকল্প বাঁশের সাঁকো নয়। ফলে সেতু এখানে করতেই হবে।”

উলুবেড়িয়ার সাংসদ সুলতান আহমেদের আশ্বাস, “কুলিয়ায় পাকা সেতু অবশ্যই হবে। শীঘ্র যাতে কাজ শুরু করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement