অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে প্রতি বছরই। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ করবে কে? রেল না ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর?
দু’পক্ষের চাপান-উতোরের জেরে শিলান্যাসের চার বছর পরেও প্রস্তাবিত বাগনান-আমতা রেলপথের নির্মাণকাজ এখনও কার্যত শুরুই হল না। এত দিনে বাগনান স্টেশন থেকে মাত্র এক কিলোমিটার এলাকায় মাটি ফেলা এবং দামোদরের বুকে সেতুর জন্য কয়েকটি স্তম্ভ তৈরি করা ছাড়া কাজ কিছুই হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করে না-দেওয়ার ফলেই প্রকল্পের এই হাল। হাওড়া জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের পাল্টা দাবি, তাদের হাতে আর এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব নেই। সে দায়িত্ব সরাসরি রেল দফতরেরই।
২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি প্রস্তাবিত বাগনান-আমতা রেলপথের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিনই কাজ শুরু হয়। কথা ছিল, দু’বছরের মধ্যে চালু হয়ে যাবে রেলপথ। প্রকল্প মোতাবেক ১৬ কিলোমিটার এই রেলপথে দামোদরের উপরে তিনটি বড় সেতু এবং বিভিন্ন খালে ১৫টি ছোট সেতু তৈরির কথা। হারোপ এবং ফতেপুরে হবে দু’টি স্টেশন। এ ছাড়া থাকবে সাতটি লেভেল ক্রসিং। প্রকল্পের জন্য মোট খরচ ধরা হয় ১০৩ কোটি টাকা।
শিলান্যাসের সময় রেলমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, প্রকল্পে টাকার অভাব হবে না। রেল নিজেই জমি অধিগ্রহণ (আগে নিয়ম ছিল, রেলের কোনও প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করবে রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর) করতে পারবে। এ জন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। একই সঙ্গে মমতা ঘোষণা করেন, এই প্রকল্পে যাঁরা জমি দেবেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও তাঁদের পরিবারের এক জনকে চাকরি দেওয়া হবে। চাকরির আশাতেই বহু জমি-মালিক জমি দিতে এগিয়ে আসেন। রেলের আধিকারিকেরা শিবির করে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেন।
কিন্তু সেই কাজ বেশি দূর এগোয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দাবি, জমি-মালিকদের কাগজপত্রে বিস্তর গোলমাল ছিল। একই জমির একাধিক দাবিদার রয়েছেন। এই জটিলতার ফলে রেলের পক্ষ থেকে জমি অধিগ্রহণের কাজে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের শেষ দিকে তাদের পক্ষ থেকে জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয় হাওড়া জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে। রেলের এক কর্তার দাবি, “রাজ্য সরকার যতটা জমি দিয়েছে, ততটা কাজ হয়েছে। বাকি জমি তারা যত তাড়াতাড়ি অধিগ্রহণ করে দিতে পারবে কাজ তত এগোবে।”
রেলের পক্ষ থেকে যখন জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে দেওয়া হয়, তার পরেও সেই অধিগ্রহণের কাজ সে ভাবে এগোয়নি। সেই সময়ে ওই দফতরের আধিকারিকেরা দাবি করেছিলেন, রেলের পক্ষ থেকে কোন কোন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ তাঁদের কাছে পাঠানো হয়নি। বর্তমান অচলাবস্থা নিয়ে ওই দফতরের এক কর্তা পাল্টা দাবি করেছেন, “জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়েছিল বটে, তবে রেলের পক্ষ থেকে ফের সেই দায়িত্ব ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
বাগনান-আমতা রেল প্রকল্পটি বেশ পুরনো। আটের দশকের গোড়ায় প্রকল্পটি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। রেলের তরফ থেকে এটিকে একটি ‘করিডর প্রকল্প’ হিসাবেই দেখা হয়েছিল। অর্থাৎ, হাওড়া-খড়্গপুর শাখার সাঁত্রাগাছি থেকে কুলগাছিয়ার মধ্যে কোনও দুর্ঘটনা বা জরুরি মেরামতির কাজের জন্য রেল চলাচল বন্ধ রাখতে হলে সাঁত্রাগাছি থেকে হাওড়া-আমতা রেলপথ হয়ে বাগনান পর্যন্ত ট্রেন চালিয়ে জরুরি পরিষেবা অব্যাহত রাখা। বাগনানে এই রেলপথটি মিশে যাওয়ার কথা হাওড়া-খড়্গপুর মূল শাখার সঙ্গে। ফলে, এই রেলপথের উপযোগিতা রয়েছে বলেই মনে করেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের পদস্থ কর্তারা। ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতার আগ্রহেই বাগনান-আমতা রেল প্রকল্পের ফাইল খুলে এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়। তার পর থেকে প্রতিটি রেল বাজেটেই টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো না এগোনোয় যে সব গ্রামবাসী কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন, তাঁরা পড়ে গিয়েছেন বিপাকে। তাঁরা এখন নিজেদের জমি বিক্রি করতেও পারছেন না, ব্যবহারও করতে পারছেন না। ফলে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
বাগনানের নহলা গ্রামের বাসিন্দা তথা বাঙালপুর পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের আসিক রহমান বলেন, “তিন বছর আগে গ্রামের শতাধিক চাষি জমির কাগজপত্র রেলের কাছে জমা দিয়েছিলেন। আমরা রেলের কাছে খোঁজখবর নিতে গেলে অফিসারেরা কিছু বলছেন না। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর থেকেও কিছু জানানো হয়নি। প্রকল্পটিই আদৌ হবে কিনা বুঝতে পারছি না।”