নতুন সেতুর দু’দিকে সংযোগকারী রাস্তা না হওয়ায় পুরনো সেতু দিয়েই বিপজ্জনক ভাবে চলছে যান চলাচল।—নিজস্ব চিত্র।
যাতায়াতের দূরত্ব কমাতে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেতু। কিন্তু জমির সমস্যায় সেতুর দু’দিকে সংযোগকারী রাস্তা আর তৈরি হয়নি। ফলে এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের সেতুর দাবি পূরণ হলেও তার সুফল এখনও তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি।
জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের খবর, খানাকুল এবং পুড়শুড়ার মধ্যে সংযোগকারী দিগরুইঘাট-মুণ্ডেশ্বরী সেতু নির্মাণ শেষ হয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। সেতুর দু’দিকে রাস্তার জন্য জমির প্রয়োজনে স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে প্রশাসন। কিন্তু জমির দাম মনোমত না হওয়ায় বেশ কিছু চাষি ক্ষতিপূরণের চেক নেননি। সেই কারণে সেতুর দু’দিকে যোগাযোগকারী রাস্তার কাজ আটকে গিয়েছে। যদিও স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, সেতুর কাজ হয়ে গেলেও রাস্তা তৈরির জন্য সরকারি স্তরে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের সঙ্গে কোনও আলোচনাতেই বসা হয়নি। এই অবস্থায় সেতুর ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। সমস্যা মেটাতে ‘দিগরুইঘাট-মুণ্ডেশ্বরী সেতু নির্মাণ দাবি সমিতি’র তরফে এ ব্যাপারে পদক্ষেপের দাবিতে লাগাতার মুখ্যমন্ত্রী-সহ সংশ্লিষ্ট দফতর এবং জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেদন পাঠানো হলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। সমিতির সম্পাদক শান্তনুকুমার পুরকাইতের অভিযোগ, সরকার কাল্পনিক বাধা খাড়া করে কাজ শুরু করছে না। অনিচ্ছুক চাষিদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেই বিষয়টি মিটে যায়। কারণ সেতুর প্রয়োজনীয়তা মানুষ উপলব্ধি করছেন। কিন্তু সরকারের কোনও হেলদোল নেই।
সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণের জন্য মোট ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নানা মাপের ওই সমস্ত জমির মালিক মোট ৩২৫ জন। জমি অধিগ্রহণের নোটিস জারি করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩ জুলাই। শুনানিও হয় ওই বছরেরই অগস্টে। জমির দাম ধার্য হয়েছিল হয় ৪ লক্ষ টাকা বিঘা বা একর প্রতি ১২ লক্ষ টাকা। ৩২৫ জন জমির মালিকের মধ্যে প্রায় ১০০ জন সরকারি ওই দামে সম্মত হয়ে চেকও নিয়ে নেন চলতি বছরের ১৪ জানুযারি। গত মে মাসে ওই ২৫ বিঘা জমি ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর পূর্ত দফতরকে হস্তান্তরও করে। পূর্ত দফতর থেকে খুঁটি পঁুতে জমি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। যাঁরা চেক নেননি সেই অনিচ্ছুক চাষিদের পক্ষে অজয় মাইতি বলেন, “সেতুর জন্য আমরা প্রথম থেকেই জমি দিতে চেয়েছি। আমাদের দাবি ছিল জমির বর্তমান মূল্য দেওয়া হোক। যেখানে বর্তমান জমির দর বিঘা প্রতি ১০ লক্ষ টাকা, সেখানে সরকার দিচ্ছে ৪ লক্ষ টাকা। সরকারের তরফে কেউ এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনাতেও বসছে না।”
হুগলি জেলার সভাধিপতি মেহবুব রহমান বলেন, “যে সব অনিচ্ছুক চাষি এখনও চেক নেননি, স্থানীয় বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে খুব শীঘ্রই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা হবে।” পুড়শুড়ার বিধায়ক (সেতুর দু’পাড়ের পঞ্চায়়েত এলাকাগুলি পুড়শুড়া বিধানসভা কেন্দ্রের আওতায় পড়ে) তৃণমূলের পারভেজ রহমান বলেন, “আমি যথাযথ জায়গায় তদবির করছি, আশা করছি দ্রুত সমস্যা মিটি যাবে।’’ আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দার বলেন, “সেতুটি যাতে দ্রুত চলাচলের উপযোগী করা যায় সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে জানাব।”
পুড়শুড়া ও খানাকুলের ২৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি মতো অহল্যাবাঈ রোড থেকে সামন্ত রোড হয়ে ৮ কিলোমিটার দূরে দিগরুইঘাটের কাছে পুড়শুড়া-রাধানগর রোডকে মুণ্ডেশ্বরী যেখানে দু’ভাগ করেছে সেখানেই তৈরি হয়েছে সেতুটি। ১৯৯৮ সালে সেতুর দাবিতে একটি কমিটি তৈরি হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পূর্ত দফতর সরেজমিন দেখার পর ২০০১ সালে জমি জরিপ ও নকশার কাজ শেষ হয়। সেই সময় আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। কিন্তু তার পরেও বেশ কিছু দিন কাজ আটকে ছিল জেলা পরিষদে। পরে কমিটি তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দ্বারস্থ হয়। ২০০৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকল্পের অনুমোদন মেলে। কাজ শুরু হয় ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু সেতু নির্মাণকারী সংস্থা কাঁচা মালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে এই অভিযোগ তুলে বছর খানেক পর কাজ বন্ধ করে দেয়।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেতুর তৈরির ভার তুলে দেওয়া হয় অন্য ঠিকাদার সংস্থা ‘ম্যাকিনটোশ বার্ন লিমিটেড’-এর হাতে। সম্পূর্ণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২০ কোটি টাকা। রাস্তা-সহ কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে। সেতুর কাজ শেষ হয়ে যায় ২০১৩-র জুলাই মাসেই। নতুন সেতুকে কেন্দ্র করে পুড়শুড়া ও খানাকুলের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সেতুর দু’দিকে রাস্তা হলে কলকাতা থেকে তারকেশ্বর পৌঁছতে ১৮ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। স্থানীয় চাষিরাও সহজেই ফসল নিয়ে পৌঁছতে পারবেন চাঁপাডাঙা, শেওড়াফুলি, আরামবাগ প্রভৃতি এলাকার বাজারে। এ ছাড়া অহল্যাবাঈ রোডে উপরে রামমোহন সেতু বন্ধ হয়ে গেলে নতুন সেতুটি দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করবে।