রাজরাজেশ্বরী যুব সমিতি। মহিলা ভলিবল দলের জন্ম হয়েছিল যেখানে।
সবুজ ঘাসে সোনালি দিন আর নেই।
এক সময়ে তিন তিন জন মেয়ে জাতীয় ভলিবল দলে দাপিয়ে খেলেছিলেন। অচিরা গঙ্গোপাধ্যায়, বিজলী চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রেয়সী বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরোদস্তুর মেয়েদের আস্ত একটা দলই ছিল কোন্নগর শহরে। সেই দলই আজ অতীত। ভলিতে আগ্রহী মেয়েদের সংখ্যা কমতে কমতে গোটা দলটাই উঠে গিয়েছে।
অথচ বিজলী নিজে বাংলা মহিলা ভলিবল দলের অধিনায়িকা পর্যন্ত ছিলেন। সেটা আশির দশকের গোড়ায়। জাতীয় পর্যায়ে রেলওয়েজের হয়ে তিন বার এবং জাতীয় দলের হয়ে ৪ বার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জাতীয় চ্যাম্পিয়নের শিরোপাও পেয়েছেন। এখন রেলে চাকরি করছেন। তাঁর সহজ-সরল স্বীকারোক্তি, “যত বড় পর্যায়েই খেলি না কেন, আমাদের উত্থান কিন্তু রাজরাজেশ্বরী যুব সমিতিতে।” তাঁর কথায়, “এখনও নানা অনুষ্ঠানে ক্লাবে যাই। কিন্তু মেয়েদের দলটা যে আর নেই, সেটা ভেবে খুবই খারাপ লাগে।”
বিজলির সতীর্থ শ্রেয়সী বন্দ্যোপাধ্যায় ভলিবলে রাজ্য থেকে শুরু করে দেশেরও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি বলেন, “হুগলির প্রথম মহিলা ভলিবল দল কোন্নগরেই ছিল।” শ্রেয়সীর বাবা সঞ্জীব এবং কাকা সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দলের কোচ ছিলেন। শ্রেয়সীর বিলক্ষণ মনে আছে, জাতীয় প্রতিযোগিতায় কেরলকে হারিয়ে বাংলা যে বার চ্যাম্পিয়ন হয়, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মাঠে হাজির ছিলেন। তিনি বলেন, “খেলা দেখেই ১২ জন মেয়ে রেলে চাকরি পাই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই বদলে গিয়েছে। আমাদের সময়ে স্কুলের মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা উৎসাহ দিতেন। কিন্তু এখন পড়াশোনার পদ্ধতিটাই এমনভাবে বদলে গিয়েছে, খেলার মাঠ থেকে ছেলেমেয়েরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
শুধু কি ভলিবল? এ শহর বডিবিল্ডিং থেকে শুরু করে জিমনাস্টিক্স— সহ নানা খেলাতেই গৌরবের সাক্ষ্য রেখেছে অতীতে। ৬৫ বছরের পুরনো ক্লাব মনসাতলা ব্যায়াম মন্দির থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন জিমন্যাস্ট, বডিবিল্ডাররা। কিশোর ব্যায়াম প্রতিষ্ঠান, সপ্তর্ষী ব্যায়াম মন্দির, অরবিন্দ ব্যায়াম সমিতিও কোন্নগরের ক্রীড়াক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের ভূমিকা পালন করে এসেছে। আজও নানা খেলাধূলোর চর্চা হয় এই সব ক্লাবে।
মনসাতলা ব্যায়াম মন্দিরের প্রদীপ সাহাকে এলাকায় লোকে শিবুদা বলেই জানেন। ১৯৮২ এবং ’৮৪ সালে তিনি জিমনাস্টিক্সে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ’৮১ সাল থেকে টানা তিন বার সারা ভারত স্কুল প্রতিযোগিতাতেও চ্যাম্পিয়ন হন। এখন পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। তিনি বলেন, “অতীতে কি সব খেলোয়াড় ছিল এখানে! ধারাবাহিক ভাবে খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। এখন সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। প্রতিভা হয়তো আছে। কিন্তু সংখ্যার বিচারে এখন অনেকটাই পিছিয়ে।” তাঁর কথায়, “এখন এই সব খেলায় সে ভাবে আসেই না ছেলেমেয়েরা। পড়াশোনায় অত্যাধিক চাপ দেওয়াও এর একটা কারণ। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, খেলার মাঠে এলে পড়াশোনার ক্ষতি হয় না। উল্টে মানসিক বিকাশ হয়।”
ইতিহাস বলছে, এই শহরের শ্যামসুন্দর ঘোষ বডি বিল্ডিংয়ে মিস্টার বেঙ্গল হয়েছিলেন। পরিমলরঞ্জন ঘটকও ওই শিরোপা পান। মহিলাদের যোগাসন প্রতিযোগিতায় রূপালি সাহা প্রচুর সাফল্য অর্জন করেন। পাওয়ার লিফ্টিংয়ে বিশ্ব পর্যায়ের জুনিয়র প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছেন উত্তম ঘোষ। পাওয়ার লিফ্টিংয়েই চল্লিশোর্ধ বিভাগে দাপিয়ে খেলেছেন এখানকার ছেলেরা। এমন উদাহরণ আরও আছে।
কিন্তু অতীতে সাফল্য এনে দেওয়া খেলোয়াড়দেরই আক্ষেপ, বর্তমানে খেলাধূলোর ক্ষেত্রে সেই ছবি মলিন হয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলোর পরিকাঠামোর নিরিখেও তেমন আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি এ শহর। গোটা শহরে একটি মাত্র সাঁতারের ক্লাব। সেই কোন্নগর সুইমিং ক্লাবেই ভিড় করেন নানা বয়সের মানুষ। ফলে সেখানেও এখন ঠাঁই নাই অবস্থা।
ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি খেলে এমন দলের সংখ্যাও হাতেগোনা। কোন্নগরের ক্রীড়ামহলের খোঁজ যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন এবং কোন্নগর অলিম্পিক— মূলত এই দু’টি দলই একাধারে ক্রিকেট, ফুটবল এবং হকি খেলে। কিন্তু বর্তমানে এ শহর থেকে হকি দূরঅস্ত, ময়দানে দাপিয়ে খেলছেন এমন ফুটবলার বা ক্রিকেটারের নামও শোনা যায় কই!
কোন্নগরের ক্রীড়াজগৎ এখন যেন সুদিনের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
(শেষ)
ছবিগুলি তুলেছেন দীপঙ্কর দে।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু
বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর কোন্নগর’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,
হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।