শহরের প্রধান রাস্তা ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোডে যানজটের এই ছবি রোজকার।--সুব্রত জানা।
গাড়ি, ম্যাটাডোর, মোটর বাইক, যাতে চড়েই আসুন না কেন, উলুবেড়িয়ায় ঢুকতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে ট্রেনের। কখন ট্রেন আসবে, তার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে ৪০ মিনিট, এক ঘন্টা, কিংবা তারও বেশি।
স্টেশনে নয়, লেভেল ক্রসিংয়ে। উলুবেড়িয়ায় ঢোকা কিংবা বেরোনোর পথে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর শাখার এই লেভেল ক্রসিং পেরোতেই হবে। এই বিভাগে এত ঘন ঘন ট্রেন চলাচল করে যে, লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে এলে গাড়ি চালকেরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এড়ানো প্রায় অসম্ভব। লেভেল ক্রসিংয়ের দুই দিকে লম্বা লাইন পড়ে। মহকুমাশাসকের দফতর, উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতাল, মহকুমা আদালত, উলুবেড়িয়া থানা, উলুবেড়িয়া এসডিপিও অফিস, সবই শহরের ভিতর। উদয়নারায়ণপুর, আমতা, বাগনান, জয়পুর প্রভৃতি এলাকা থেকে কয়েকহাজার মানুষ প্রতিদিন শহরে আসেন এইসব দফতরে। লেভেল ক্রসিংয়ের অপেক্ষার সময়টা হাতে ধরেই বেরোতে হয় তাঁদের।
কিন্তু সময় কেড়ে নিতে পারে প্রাণও। মহকুমা হাসপাতালে আসেন অনেক সংকটাপন্ন রোগী। এমন এক রোগীর আত্মীয় প্রফুল্ল দত্ত বললেন, “আমার এক আত্মীয়কে নিয়ে মহকুমা হাসপাতালে আসার সময় অ্যাম্বুলান্স আটকে পড়েছিল লেভেল ক্রসিংয়ে। রোগীর অবস্থা শোচনীয়, দুশ্চিন্তায় আমাদেরও শরীর খারাপ হওয়ার উপরক্রম হয়েছিল।” গড়চুমুক, গাদিয়াড়ার মত পর্যটনকেন্দ্রে যাতায়াতের সময় লেভেলক্রশিংয়ের ফাঁদে পড়ে বেড়ানোর আনন্দটাই মাটি হয় পর্যটকদের। ফুলেশ্বরের সেচ দফতরের বাংলোয় অনেকেই আসেন সাপ্তাহান্তিক ছুটি কাটাতে। তাঁদেরও হাল হয় একই।
কেন আজও হল না লেভেল ক্রসিংয়ের উপর উড়ালপুল? রেলওয়ে উড়ালপুল তৈরির নিয়ম হল, এটি তৈরি হবে রেল ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে। রেল লাইনের উপরের অংশ তৈরি করতে যে খচ হবে সেই টাকা দেবে রেল। বাকি অংশের টাকা দেবে রাজ্য সরকার। উলুবেড়িয়ার রেলওয়ে উড়ালপুলটিও এই নিয়মে করার কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও পরিকল্পনা রেল বা রাজ্য সরকার কোনও তরফেই এখনও করা হয়নি।
যেমন কার্যকর হয়নি ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোডের ভিড় কমাতে বাইপাসের পরিকল্পনা। দিনের পর দিন পাল্লা দিয়ে শহরে বেড়েছে অটো রিকশা, ট্রেকার, ছোট গাড়ি। গাড়ির চাপে ওটি রোড কার্যত অবরুদ্ধ। বিশেষ করে সকালে ও সন্ধ্যায় গরুহাটা মোড়, স্টেশন রোডের মোড়, মহকুমা শাসকের দফতরের সামনে, মহকুমা আদালতের সামনে গাড়ির ভিড়ে মানুষের চলাচল করা দায় হয়ে দাঁড়ায়। তার উপরে ফুটপাথ দখল করে চলছে ব্যবসা। শনিবার বসে গরুহাট।
এর উপরে রয়েছে ওটি রোডের দু’ধারে গড়ে ওঠা নার্সিং হোম। অ্যাম্বুলান্সের ভিড়, রোগীর আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে রাস্তার দু’পাশ যেন মেলার আকার নেয়। স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন পালের আক্ষেপ, “আদালত বা মহকুমা শাসকের দফতরে এলে, মোটরবাইক যে কোথায় রাখব তার জায়গা পাই না। সব ফুটপাথ দখল হয়ে গিয়েছে।” বছর দুই আগে রাস্তার দুই পাশে এক ফুট করে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে সেই তুলনায় অনেক বেশি। ফলে এই ‘টোটকা’ চিকিৎসা কোনও কাজে লাগেনি।
এখন সিভিক পুলিশ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে যানজট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশ কর্তারা। কিন্তু দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বাসিন্দাদের দাবি, ওটি রোডের সমান্তরাল আরও একটি বাইপাস রাস্তা দরকার। এ বিষয়ে হাওড়া জেলা প্রশাসন বছর দশেক আগে থেকেই চিন্তা শুরু করেছে। উলুবেড়িয়া ১ ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের খবর, ওটি রোডের সমান্তরাল মেদিনীপুর ক্যানেলের পাড় ধরে এই বাইপাস রাস্তার পরিকল্পনা করা হয়। এই দফতরকেই জমির বিষয়টি সমীক্ষা করতে দেওয়া হয়। এখানে যে পর্যাপ্ত সরকারি জমি পাওয়া যাবে সেই রিপোর্টও তারা জমা দিয়েছে বলে এই দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। তার পরে ২০০৯ সালে কেএমডিএ-এর পক্ষ থেকে জায়গাও পরিদর্শন করা হয়। কিন্তু তার পরে আর এ বিষয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি।
শহরের পুরনো বাসিন্দা কবি সুপ্রিয় ধরের স্মৃতিচারণ, “কয়েক বছর আগেও দেখেছি, এই শহরের একটা মফস্সলি গন্ধ ছিল। মহকুমাশাসকের দফতরের সামনের বাসস্ট্যান্ডে সার দিয়ে দাঁড়াতো বিভিন্ন রুটের বাস। যাত্রীদের নিয়ে হেলতে দুলতে শহরের উপর দিয়ে তারা চলে যেত। কোনও যানজট হত না। কিন্তু ছোট গাড়ি ও অটো রিকশার সংখ্যা সহসা বাড়তে লাগল। বাস গেল উধাও হয়ে। এখন তো এই শহরের রাস্তায় শুধু গাড়ি আর মানুষের ভিড়। অসহ্য পরিস্থিতি।”
ওটি রোডের ধারে বাইপাস আর লেভেল ক্রসিংয়ে উড়ালপুল। এই দু’টিই বাঁচাতে পারে শহরকে, মনে করছেন বাসিন্দারা। উলুবেড়িয়া দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক পুলক রায় বললেন, “বিষয়টি রেলের অধীনে, তাই রাজ্য উড়ালপুলের জন্য কেন্দ্রের কাছে দরবার করছে। উড়ালপুল তৈরি হয়ে গেলেই বাইপাস রাস্তাও তৈরি হয়ে যাবে।”
কিন্তু তা কবে? সেই প্রশ্নের উত্তর নিত্য খুঁজছে উলুবেড়িয়া।