দায়িত্ব নিয়েই সদ্য প্রাক্তন উপপ্রধান এবং তাঁর বাবাকে বেআইনি নির্মাণের জন্য নোটিস ধরালেন রিষড়ার নতুন পুরপ্রধান। যা নিয়ে শাসকদলের অন্দরে সোরগোল পড়ে গিয়েছে। যদিও ওই নির্মাণ সংক্রান্ত ফাইল ‘উধাও’ বলে পুরসভা সূত্রে খবর।
কোথাও নিয়ম ভেঙে সাত তলা, কোথাও নির্দিষ্ট জায়গা না ছেড়ে নির্মাণ— হুগলির এই পুরশহরে ‘বেআইনি’ নির্মাণ নিয়ে চাপানউতোর কম হয়নি। যার জেরে দলের নির্দেশে বদলে গিয়েছেন পুরপ্রধান। পদত্যাগ করেছেন উপ-পুরপ্রধান। সম্প্রতি নতুন পুরপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন তৃণমূল নেতা বিজয়সাগর মিশ্র। দায়িত্বে এসেই ‘বিতর্কিত’ বিভিন্ন নির্মাণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারদের নোটিস ধরাতে শুরু করেছেন তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই তালিকায় রয়েছে প্রাক্তন উপ-পুরপ্রধান সাকির আলি এবং তাঁর বাবার নাম। সাকির আলি আবার আরামবাগের সাংসদ আফরিন আলির স্বামী। ফলে বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে। সর্বোপরি সাকির এখনও পুরসভার কাউন্সিলর। তা ছাড়া শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী বলে পরিচিত। তাই বেআইনি নির্মাণ নিয়ে নোটিস ধরানোর এই প্রক্রিয়া আদতে দুই সাংসদের ঠান্ডা লড়াই বলে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশ জানিয়েছেন।
পুরসভা সূত্রের খবর, রিষড়ার গাঁধী সড়কে সাকির একটি পাঁচতলা আবাসন তৈরি করছেন। নতুন পুরপ্রধানের সই করা পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়েছে, পর্যাপ্ত ছাড় না দিয়ে আবাসনটি তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া চতুর্থ এবং পঞ্চম তলার অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কেন ‘অননুমোদিত’ ওই নির্মাণ ভাঙা হবে না বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সাকিরের বাবা মহম্মদ আবুলাসকেও পুরসভার পক্ষ থেকে নোটিস দিয়ে জানানো হয়েছে, রিষড়ার রামকৃষ্ণ শাহ রোডে তিনি বেআইনি নির্মাণ করেছেন।
নোটিসের জবাবে সাকির জানিয়েছেন, ২০১৫-’১৬ সালে তিনি তিনতলা নির্মাণের ছাড়পত্র পান। সেই মতো তিনতলা তৈরি হয়। পরে চতুর্থ তল এবং সিঁড়ির ঘর করা হয়। তার জন্য তিনি পুরসভায় নকশা জমা দেন। তা ছাড়া তাঁর কাছে পড়শিদের ‘নো-অবজেকশন’ চিঠিও রয়েছে। এর জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর পুরসভায় নির্দিষ্ট টাকাও জমা দেন তিনি। আবুলাস নোটিসের উত্তরে পুরসভাকে জানান, ১৯৭৫-’৭৬ সালে তিনি দোতলা বাড়ি করেন পুরসভার অনুমোদন নিয়ে। পুরসভার অ্যাসেসমেন্টের পর তিন তলা এবং সিঁড়ির ঘর করা হয়। এর জন্য প্রতিবেশীদের ‘নো-অবজেকশন’ চিঠি জমা দেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর এই কাজের জন্য পুরসভায় টাকাও জমা করা হয়। তখন কোনও সমস্যা হয়নি। সাকির ও আবুলাসের দাবি, পুরসভা সবকিছুই খতিয়ে দেখেছে। ফলে ‘বেআইনি’ নির্মাণের প্রশ্ন নেই।
পুরসভা সূত্রের খবর, সাকির এবং আবুলাশ যেদিন (গত ২৬ সেপ্টেম্বর) পুরসভার তহবিলে টাকা জমা দেন, সেদিনই শঙ্করপ্রসাদ সাউ পুরপ্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন। এর পরে সাকির এবং আবুলাসের নির্মাণ সংক্রান্ত ফাইল পুরসভা থেকে ‘উধাও’ হয়। গত ১৯ নভেম্বর পুরসভার এক্সিকিউটিভ অফিসার রিষড়া থানায় ডায়েরি করেন। তাতে বলা হয়েছে, সাকির ওই দু’টি ফাইল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে পুরসভার তরফে সাকির এবং আবুলাসকে ফের চিঠি পাঠিয়ে ওই দুই নির্মাণের কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে। যদিও সাকিরের বক্তব্য, ‘‘ফাইল কোথায় গিয়েছে? তা আমি কী করে বলব! ওরাই খুঁজে দেখুক।’’
তৃণমূলের অন্দরের খবর, সাকিরের সঙ্গে বর্তমান পুরপ্রধানের সম্পর্ক ‘অম্ল-মধুর’। আর সেই কারণেই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পরামর্শে সাকিরকে ‘চাপে রাখতে’ই তাঁকে ও তাঁর বাবাকে ওই নোটিস ধরানো হয়েছে। সাকিরের অভিযোগ, ‘‘আমাকে রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা করার চক্রান্ত হচ্ছে।’’
পুরপ্রধান বিজয় মিশ্রর কথায়, ‘‘সবে মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। এর মধ্যেই আমরা ১২টি নির্মাণ নিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। সমস্ত বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা তিনি যতই প্রভাবশালী হোন। এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা বৃথা।’’
দীর্ঘদিন ধরে বেআইনি নির্মাণ নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসা রিষড়ার মানুষ অবশ্য পুরসভার এই পদক্ষেপকে বাহবা দিয়েছেন। অনেকেই বলছেন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই হোক বা অন্যকিছু, বেআইনি নির্মাণ নিয়ে তবু টনক নড়েছে পুরসভার। এটাই বা কম কী!