বাড়ছে গাঁজার আসর, চুরি-ছিনতাইও
Drug Addiction

আঠার নেশায় ডুবছে ছোটরা

একই ছবি পল্লিশ্রী মোড়, গৌরহাটি মোড় বা হাসপাতাল চত্বরেও। ক্রেতাদের বেশির ভাগই ছোট। ১২-১৪ থেকে ১৮-১৯ বছরের। তারা কেনেও একই জিনিস। আঠার টিউব।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

আরামবাগ শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:০৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

আরামবাগ বাসস্ট্যান্ডের মনিহারি দোকানগুলিতে প্রতি সন্ধ্যায় ভিড় বাড়ছে।

Advertisement

একই ছবি পল্লিশ্রী মোড়, গৌরহাটি মোড় বা হাসপাতাল চত্বরেও। ক্রেতাদের বেশির ভাগই ছোট। ১২-১৪ থেকে ১৮-১৯ বছরের। তারা কেনেও একই জিনিস। আঠার টিউব।

পড়াশোনা বা অন্য কোনও কাজের জন্য নয়। আরামবাগ শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলির কিশোর-তরুণদের একটা বড় অংশ আঠার নেশায় মজেছে। যে কোনও দিন শহরের নির্জন এলাকায় গেলেই দেখা যাবে, রুমালে বা ন্যাকড়ায় ওই আঠা ঢেলে তা শুঁকে নেশা করছে ওই ছেলেপুলেরা। সোমবার সন্ধেবেলাতেই আরামবাগ বাসস্ট্যান্ডের পিছনে জনাচারেক ছেলেকে দেখা গেল নেশা করতে।

Advertisement

এটা শুঁকলে কী হয়?

‘‘অনেকক্ষণ ফুর্তিতে থাকা যায়।”— মুখ না তুলেই উত্তর দিল একজন। দোকানিরা মানছেন, ওই আঠার টিউবের বিক্রি বেড়েছে। তাঁরা জানান, প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫টি ৫০ মিলিলিটারের ওই টিউব বিক্রি হচ্ছে। যার দাম ২৫ টাকা। যারা এই নেশা করছে, তাদের কেউ দোকানে ঝাঁট দেয়, গাড়ি ধোয়, জল তোলে বা কারও ফাইফরমাস খাটে। যারা কিছুই করে না, তারা টাকা পায় কোথায়? একটি ছেলে অবলীলায় মেনে নিল, ‘‘মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে টাকা চুরি করি।’’

ছেলেপুলের এই নেশার কথা অনেক পরিবারই জানে। কিন্তু ঠেকাতে পারছে না। কারও বাবা হয়তো রিকশা চালান, মা পরিচারিকার কাজ করেন। কারও বাবা হয়তো দিনমজুর। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সময় ছেলে কোথায় কী করছে খোঁজ রাখতে পারেন না। তাঁরা চান, প্রশাসন ব্যবস্থা নিক। শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মনোজ রায় একটি শপিং মলে কাজ করেন। তিনি জানেন তাঁর বছর সতেরোর ছেলে আঠার নেশায় আসক্ত। মনোজের খেদ, ‘‘ছেলেটা আঠার নেশায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে টাকা চুরি করছে। শাসন করেও কিছু হচ্ছে না। পুলিশকে ওদের ঠেকের হদিস দিয়েছি। কিছুই ব্যবস্থা হয়নি।” শহরবাসীর অনেকেরই একই অভিযোগ, প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই শহরে নেশার রমরমা। আর এর জেরেই নানা অপরাধও বাড়ছে।

মহকুমা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘ধারাবাহিক অভিযান চালানো হয়। সামাজিক এই অবক্ষয় রুখতে স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা চাইছি আমরা। মাদক সংক্রান্ত বিষয় নজরে এলে থানায় খবর দেবার অনুরোধ করা হয়েছে।” তবে, পুলিশও মানছে, শ্লীলতাহানি, বধূ নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি-ছিনতাই, পথ দুর্ঘটনা ইত্যাদি ৮০ শতাংশই ঘটছে মাদকজনিত কারণে।

শুধু কী আঠার নেশা? শহরে অবাধে চলছে গঞ্জিকা সেবনও। মনোজই বলেন, “প্রতিদিন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পোল্ট্রি সংলগ্ন শীতলা মন্দিরে সামনে অবাধে গাঁজার আসর চলছে।” গৌরহাটি মোড়ের এক রিকশা-চালকের স্ত্রী সন্ধ্যা মালিকের ক্ষোভ, “সারাদিন গাঁজার নেশায় চুর হয়ে থেকে স্বামী শুধু নিজেকেই ধ্বংস করছে না, পরিবারকেও শেষ করছে। এগুলো সামলানোর কি কোনও উপায় নেই?”

নজরদারি যে নেই, তা স্পষ্ট শহরে একবার চক্কর দিলেই। ফলের দোকানেও মিলছে গাঁজার কলকে! আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড, হাসপাতাল মোড়, বসন্তপুর মোড়, গৌরহাটি মোড়, পল্লিশ্রীর মতো কয়েকটি এলাকার কিছু ফলের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এক-একটি দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৭০টি পর্যন্ত কলকে বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া, রয়েছে পান-গুমটি, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারাও। গাঁজার আসর বসছে বসন্তপুরে মিনি মার্কেট চত্বর, রেল লাইন, চাঁদুর ফরেস্ট, হাসপাতাল চত্বর, পশু হাসপাতাল চত্বর এবং দ্বারকেশ্বর নদীর চরে। গঞ্জিকাসেবীদের থেকেই জানা গিয়েছে, বসন্তপুরের একটি ঠেকে গাঁজা সেবনের পর সন্দেশ বা রসগোল্লা খাওয়ার রেওয়াজ আছে। পল্লিশ্রীর কাছে একটি আসরে ঘন দুধ রাখা থাকে। কেউ আবার কলকের মুখে লবঙ্গ রেখে ভিন্ন স্বাদ নেয়।

দুই নেশার ক্ষেত্রেই বস্তু দু’টির সহজলভ্যতাকেই দায়ী করেছেন শহরের মানুষ।

মনোবিদ মোহিত রণদীপের মতে, শুধু আঠা নয়, স্পিরিট, ডিজেল, পেট্রলের মতো উদ্বায়ী পদার্থ, কেরোসিন, জুতো পালিশের উপাদান শুঁকেও অনেকে নেশা করে। এই সব গন্ধ নাক দিয়ে সরাসরি শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে গিয়ে পৌঁছয়। এতে আচ্ছন্ন ভাব তৈরি হয়। তাৎক্ষণিক ভাল লাগার আমেজ তৈরি হয়। কিন্তু এই সব নেশা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। সচেতনতা কম থাকায় কমবয়সীদের মধ্যে আঁঠা শুঁকে নেশার প্রবণতা বাড়ছে। অভিভাবকদের এ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছোটদের আঠা বিক্রি করতে দোকানদারদেরও সচেতন হতে হবে। প্রশাসনকেও নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে। যারা নেশা করছে, তাদের চিহ্নিত করতে সরকারি স্তরে নজরদারি ভীষণ জরুরি। যারা এই নেশা শুরু করেছে, তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। মূলত কাউন্সেলিং দরকার। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওষুধেরও প্রয়োজন হতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement