বাগনানের চন্দ্রপুর এলাকা।
দিন কয়েক আগে উলুবেড়িয়ার মহিষরেখার ঘটনা। ঘড়িতে রাত ১২টা। মুম্বই রোড ধরে দামোদর সেতু পার হয়ে হাওড়ার দিকে আসার পথে আচমকা চাকার হাওয়া খুলে যায় একটি ১০ চাকার লরির। চালক ও খালাসি মিলে চাকা পাল্টাচ্ছিলেন। আচমকা মোটরবাইকে চড়ে সেখানে হাজির হয় তিন যুবক। হাতে ধারালো অস্ত্র। চালককে ভয় দেখিয়ে সব টাকা কেড়ে নিয়ে ফের বাইকে চম্পট দেয় তারা।
এই এলাকায় একটি বড় পাইপের কারখানা আছে। রাতভর শ্রমিকেরা যাতায়াত করেন মু্ম্বই রোড ধরে। কয়েকজন শ্রমিক ওই ঘটনা দেখলেও ভয়ে মুখ খুলতে চাননি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক জানান, চালকের কাছ থেকে সব টাকা ছিনতাই করে দুষ্কৃতীরা যখন চলে যাচ্ছিল সেই সময় চালক কাকুতি-মিনতি করে তাদের কাছে মাত্র ২০০ টাকা চেয়েছিল খাওয়ার জন্য। তা শুনে এক দুষ্কৃতী তার সঙ্গীদের বলে, দে তো ওর গলায় চাকু চালিয়ে। এর পরেই মোটরবাইকে হাওয়া হয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মুম্বই রোডে ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে নিয়মিত। উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুর শিল্পতালুক থেকে বাগনানের চন্দ্রপুর জেলেপাড়া— এই এলাকাতেই দাপট বেশি দুষ্কৃতীদের। সব ক্ষেত্রে ঘটনাও প্রায় এক। কোনও ব্যক্তি একলা হেঁটে বা সাইকেলে এই এলাকা দিয়ে গেলে প্রায়ই ছিনতাইকারীদের শিকার হতে হয় তাঁকে। দুষ্কৃতীরা আসে মোটরবাইকে চড়ে। দলে থাকে তিন বা চার জন। নিরীহ সাইকেল আরোহী বা পথচারীর কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে তারা চম্পট দেয়।
বাঁদিকে, বীরশিবপুর অঞ্চল। ডানদিকে, মহিষরেখা সেতু।
মাসতিনেক আগের ঘটনা। বকরি ইদের নমাজের আগের দিন রাত ১১টা নাগাদ গরু বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে নহলা গ্রামে বাড়ি ফিরছিলেন এক ব্যবসায়ী। মহিষরেখা সেতুর কাছে মোটরবাইক আরোহী দুষ্কৃতীরা তাঁর পথ আটকায়। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সব টাকা কেড়ে নিয়ে চলে যায়। দুষ্কৃতীদের শিকার থেকে বাদ যান না ট্রাকচালকেরাও। মাসে অন্তত ১০-১২ বার মুম্বই রোডের এই এলাকা দিয়ে ট্রাকে মালপত্র নিয়ে যাতায়াত করেন এমন এক ট্রাকচালক জানান, জেলেপাড়া, মহিষরেখা বা বীরশিবপুরে ট্রাক বিকল হলে আর রক্ষা নেই। মূর্তিমান আতঙ্কের মতো রাস্তা ফুঁড়ে হাজির হয় ছিনতাইকারীরা।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েই রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। উলুবেড়িয়া ও বাগনান থানার সীমানা এলাকা মহিষরেখা। ফলে এখানে কোনও ঘটনা ঘটলে দুটি থানাই পরস্পরের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করে। যার পরিণামে মহিষরেখা দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। মাধবপুর, মুর্গাবেড়িয়া, নহলা, বাড় প্রভৃতি গ্রামের বহু মানুষ গভীর রাতে কাজ সেরে মহিষরেখা হয়ে বাড়ি ফেরেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নহলার এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘রাতে মহিষরেখা দিয়ে যাতায়াতের সময় আতঙ্কে ভুগতে থাকি।’’ বীরশিবপুর বা জেলেপাড়াতেও রাতে পুলিশের টহলদারি থাকে না বলে অভিযোগ।
হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য জানান, মুম্বই রোডে যারা ছিনতাই করে তারা স্থানীয় দুষ্কতী নয়। ছিনতাই করে তারা অন্য জেলায় পালিয়ে যায়। তবে মুম্বই রোডের বেশ কিছু এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও আঁটোসাটো করা হবে।
বাসিন্দারা জানান, ২০১৪ এবং ’১৫ সালে মুম্বই রোডের বিভিন্ন এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল। তবে পুলিশ কড়া হাতে তা দমন করে। কয়েকজনকে ধরা হয়। কিছুদিন শান্ত ছিল এলাকা। কিন্তু ফের একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুলিশের অবশ্য দাবি, হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশ এলাকায় রাতে প্রতিটি থানা যেমন টহল দেয়, তেমনই ডোমজুড় থেকে কোলাঘাট পর্যন্ত জেলা পুলিশের চারটি বিশেষ টহলদারি গাড়িও নজরদারি চালায়। দুটি গাড়িতে থাকেন ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসাররা। সম্প্রতি বীরশিবপুর থেকে তিনজন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতারও করা হয়। তারা লিলুয়ার বাসিন্দা। বীরশিবপুর শিল্পতালুকের সামনে মোটরবাইকে এসে তারা রাতে ছিনতাই করছিল।
ছবি: সুব্রত জানা।