সেই চুল্লি। নিজস্ব চিত্র
বিপদে-আপদে গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়ানো তাঁর স্বভাব। গ্রামের খোলা শ্মশানে দেহ সৎকার হতে দেখলেই দূষণ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হতেন। মরা পোড়ার দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। অনেক দিন ধরে ভাবছিলেন, বিহিত করতে হবে। শেষমেশ নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ২ লক্ষ টাকা তুলে ওই শ্মশানেই দূষণহীন চুল্লি বানিয়ে ফেলেছেন হাওড়ার বাগনানের খানপুর গ্রামের বাসিন্দা, দমকলকর্মী গণেশ সাউ। পেয়েছেন বিধায়ক তহবিলের চার লক্ষ টাকা সাহায্যও।
কেমন এই চুল্লি?
চুল্লির সবচেয়ে নীচের স্তরে ছাই পড়ার ‘চেম্বার’। দ্বিতীয় স্তরে কাঠ রাখার জায়গা। তৃতীয় স্তরে দেহ রাখা হয়। চতুর্থ স্তর হল একেবারে উপরে জলের ট্যাঙ্ক। দেহ সৎকারের সময়ে ধোঁয়া চিমনির মাধ্যমে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে দিয়ে পরিস্রুত হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। চুল্লিটি পুরোটা ঢাকা। সেই কারণে দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে সেটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। এমনকী কাঠ যখন জ্বলে তা-ও দেখা যায় না বাইরে থেকে।
নতুন নির্মাণের নকশা পুরোপুরি তাঁর বলে দাবি গণেশবাবুর। যা দেখে গিয়েছেন ব্লক অফিসের ইঞ্জিনিয়াররা। নির্মাণে কোনও খুঁত মেলেনি বলে তাঁরা জানিয়েছেন। বাগনান-১ ব্লকের বিডিও সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’’ বিধায়ক অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘এই রকম চুল্লি আমি এর আগে দেখিনি। এতে খুশি হয়ে আমি বিধায়ক তহবিলের টাকা দিয়েছি। আমার বিধানসভা এলাকায় স্কুল বা জনবসতি লাগোয়া শ্মশানগুলিতে এই রকম দূষণবিহীন চুল্লি করতে উদ্যোগী হব।’’
বছর আটচল্লিশের গণেশবাবু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁর মাথায় এই পরিকল্পনা এল কোথা থেকে? গণেশবাবুর দাবি, ‘‘দমকলের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজের সুবাদে এ বিষয়ে কিছু প্রাথমিক জ্ঞান আছে আমার। সেটাই চুল্লি তৈরিতে কাজে লাগাই। খোলা শ্মশানে মরা পোড়া দেখা অসহ্য।’’
২০১২ সাল থেকে পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন ওই দমকলকর্মী। তিনি তখন গ্রামের শ্মশান-কমিটির সদস্য। প্রথমে শ্মশানের জমি মাটি ফেলে ভরাট করেন। ইটের গাঁথনির কাজ তিনি ছুটির দিনগুলিতে নিজের হাতে করেছেন। চুল্লির চিমনি আর আর জলের ট্যাঙ্ক হাওড়ার কারখানা থেকে বরাত দিয়ে করিয়ে এনেছেন। বিধায়ক তহবিলের টাকায় চুল্লির মাথায় কংক্রিটের ছাউনি তৈরি হয়। গত বছরের ২৯ মার্চ নবগঠিত চুল্লিতে প্রথম শবদাহ হয়। নিরূপদ্রবে দেহটি দাহ হওয়ার পরে গ্রামবাসীরা খুশি হন। প্রথমে এই প্রচেষ্টাকে তাঁরা উপহাস করলেও পরে গণেশবাবুর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। সকলকে সঙ্গে নিয়ে গণেশবাবু ওই জমি ‘রেকর্ড’ করিয়েছেন শ্মশানের নামে। নিজে এখন শ্মশান-কমিটির প্রধান। শ্মশানে রয়েছে ‘রেজিস্টার’। যাঁরা দেহ দাহ করেন, তাঁরা মৃতের নাম-ঠিকানা এবং বয়স রেজিস্টারে তুলে রাখেন। সেটি দেখালে পঞ্চায়েত থেকে মেলে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’।
নতুন চুল্লিতে সময় ও কাঠ কম লাগে বলে গ্রামবাসীরা প্রিয়জনের মৃতদেহ নিয়ে সেখানেই যাচ্ছেন। তাঁরা জানান, আগে খোলা শ্মশানে দাহ করতে ২০০ মণ কাঠ এবং চার ঘণ্টা সময় লাগত। এখন ১০০ মণ কাঠ লাগে। দু’ঘণ্টা সময়ও বাঁচে। স্বামীর তৈরি শ্মশানটি গ্রামবাসীদের কাজে লাগছে দেখে খুশি গণেশবাবুর স্ত্রী সুস্মিতা। তিনি বলেন, ‘‘দেড় বছর ধরে অফিস থেকে ফিরেই স্বামী চলে যেতেন শ্মশানে। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নিজের হাতে চুল্লি তৈরির কাজ করতেন। প্রথম প্রথম বিরক্ত হতাম। কিন্তু এটা যখন উদ্বোধন হল দেখে মন ভরে গেল।’’