স্মৃতি: এই ছবি আবার ফিরবে কবে, অপেক্ষা তারই। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ
চৈত্র গিয়েছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠেও কোনও আশা নেই।
একের পর এক বায়না বাতিল হচ্ছে। সম্বৎসরের রুটি-রুজির সংস্থানের প্রশ্নে মাথায় হাত পড়েছে কামারপুকুরের যাত্রাদলগুলির সঙ্গে জড়িত সকলেরই। কারণ— লকডাউন।
যাত্রাশিল্প (অপেরা) এমনিতেই অনেক দিন ধরে ধুঁকছে। তবু কামারপুকুরের শতাব্দীপ্রাচীন এই শিল্প কলকাতার দলগুলির সঙ্গে ‘লড়াই’ করে এখনও কোনও মতে টিকে আছে। পুরনো অনেক অপেরা বন্ধ হয়েছে। আবার অনেক নতুন গজিয়েও উঠছে। বর্তমানে কামারপুকুরের ২১টি যাত্রা দল রয়েছে। কামারপুকুর চটিতেই নানা দোকানের দাওয়া বা ঘর ভাড়া নিয়ে অপেরাগুলির অস্থায়ী অফিস চলে।
সেই সব অফিসই এখন খাঁ খাঁ করছে। চৈত্র মাস পড়তেই অন্যান্য বার গমগম করে অফিসগুলি। এ বার চৈত্রের গাজনে হুগলি, বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নানা জায়গার বায়না বাতিল হয়ে গিয়েছে। টানা ৩৬ বছর ধরে যাত্রা-জগতের সঙ্গে যুক্ত, বর্তমানে ‘বঙ্গমাতা অপেরা’র মালিক জয়ন্ত পাইনের খেদ, ‘‘এই তিন মাসেই যাত্রাপালার মূল সময়। এর উপর ভরসা করেই আমাদের রুটি-রুজি এবং পরের বছরের প্রস্তুতি চলে। করোনার জেরে সব বায়না বাতিল হয়েছে। এই বিপর্যয়ে যাত্রাদলগুলোর দফারফা তো হলই, আমাদেরও না খেয়ে মরতে হবে।’’
একই রকম হা-হুতাশ শোনা যাচ্ছে শক্তিপদ ভাণ্ডারী, সব্যসাচী মৌলিক, নীলিমা বৈরাগ্য, স্বপন মণ্ডলের মতো বিভিন্ন অপেরার মালিকের মুখে। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতিটি দলের বছরে গড়ে দেড়শোটি শো হলে কিছু লাভ থাকে এবং পরের বছর দল চালনা করতে কোনও অসুবিধা হয় না। এক-একটি দলে কলাকুশলী মিলিয়ে অন্তত ২৬ জন করে থাকেন। বছরের মধ্যে শিবরাত্রি, দোলপূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা আর গাজনগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে দলগুলি।
পুজোর মরসুমের পর যাত্রার মরসুম বলতে বাংলার ওই তিন মাস। গাজনকে কেন্দ্র করে চৈত্র মাস থেকে যে যাত্রা শুরু হয়, বিভিন্ন পালা-পার্বণ উপলক্ষে তা চলে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। শক্তিপদবাবু বলেন, "করোনা আর লকডাউন পরিস্থিতিতে মূল সময়টাতেই মার খাচ্ছি আমরা। সব দলের রথের সময় নেওয়া বায়নার অগ্রিম কিছু টাকা শিল্পীদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদেরও চাপ দিয়ে টাকা আদায় করা যাবে না। অধিকাংশ শিল্পী গ্রামের দুঃস্থ পরিবারের। যাত্রা করেই তাঁরা পেট চালান।’’
শিল্পীরাও ভাল নেই। বছরে ১৫০-১৮০ দিন পর্যন্ত যাত্রা করে উপার্জন করলেও বাকি দিনগুলিতে দিনমজুরিই ভসা শিল্পীদের। শিবশঙ্কর অপেরার শিল্পী শ্যামল মাজি বলেন, ‘‘এই সময়ের আয়টা গেল। যাত্রার দিনগুলিতে আমরা এক একজন ৩০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাই। মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া টাকা কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন ভাল করে খাবার জুটছে না। ওষুধ কেনারও পয়সা নেই।’’