এখানে বাম-রক্ষণ বড় মজবুত। আর তা ভাঙার দায়িত্ব রহিম নবির ঘাড়ে!
ফুটবল মাঠে যে কোনও পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত নবি। ময়দানের পরিভাষায় ‘ইউটিলিটি ফুটবলার’। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে তিনি নতুন। নেমেই টের পেয়েছেন লড়াইটা সহজ নয়। কেননা, লড়াইটা যে ঘরে-বাইরে!
১৯৭৭ থেকেই পাণ্ডুয়া ‘লাল দুর্গ’। রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এখানে বিরোধী। গত বিধানসভা ভোটে প্রবল ‘মমতা-হাওয়া’তেও এই কেন্দ্রে জিততে পারেনি তৃণমূল। এ বার তাই এই কেন্দ্রে বাম-রক্ষণ ভাঙতে মমতার ঘুঁটি রহিম নবি। নিজের মতো করে চেষ্টাও করছেন নবি। কিন্তু দলের কিছু নেতারই ‘পাস’ কতটা পাবেন, সে ব্যাপারে তৃণমূলের অতি বড় সমর্থকও সন্দিহান। তৃণমূলের সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েই ফায়দা তুলতে চাইছে বাম-কংগ্রেস জোট।
১৬টি পঞ্চায়েত এলাকা মিলিয়ে পাণ্ডুয়া বিধানসভা কেন্দ্র। তৃণমূল এখানে সংখ্যালঘু। বামেদের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও। ১৩টি পঞ্চায়েতই দখল করে তারা। তৃণমূল পেয়েছিল ৩টি। পরে অবশ্য আরও দু’টি পঞ্চায়েতের দখল তৃণমূলের হাতে আসে। সাংগঠনিক শক্তিতেও বামেদের থেকে এখানে ঢের পিছিয়ে শাসক দল। জেলার অন্যত্র যেখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের উপর অত্যাচার চালানোর অভিযোগ উঠছে, পাণ্ডুয়ায় ঠিক উল্টো। এখানে সেই অভিযোগের সুর শোনা গিয়েছে তৃণমূল নেতাদের গলায়!
তবে, এক জায়গায় দু’পক্ষ সমান। সেটা প্রচারে। সিপিএমের আমজাদ হোসেন যেমন অস্ত্র করেছেন, ‘উন্নয়ন’ এবং ‘পরিষেবা’কে, তেমনই একই আশ্বাস বিলোচ্ছেন নবিও!
গত বিধানসভা ভোটে আমজাদ পেয়েছিলেন ৮৪,৮৩০টি ভোট। আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে তৃণমূলের নার্গিস বেগম পান ৮৪,৪৩৩টি ভোট। লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য পরিস্থিতির বদল ঘটিয়ে তৃণমূলের রত্না দে নাগ এই বিধানসভা কেন্দ্রে ৭৪৮০ ভোটের ব্যবধানে সিপিএমকে পিছনে ফেলে দেন। সিপিএম পেয়েছিল ৭৭৩১৫টি ভোট। কংগ্রেস ৫৮৩৫টি। কিন্তু সেই অঙ্ক এ বার অনেক ওলট-পালট হয়ে যাবে বলে দাবি বাম নেতৃত্বের।
এ বারে প্রথম থেকেই প্রার্থী নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন এলাকার তৃণমূল নেতাদের একাংশ। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্থানীয় কেউ প্রার্থী হোন। তিনি যেন রাজনীতির লোক হন। নবির বাড়ি পাণ্ডুয়ায় হলেও ফুটবলে নাম করার পর থেকে তিনি মূলত কলকাতাতেই থাকেন। তার উপর তিনি রাজনীতিতে নতুন। ফলে, এমন আনকোরা কাউকে প্রার্থী না করার জন্য জোর সওয়াল করেন তৃণমূল নেতারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সারা বছর দলের হয়ে ঘাম ঝরানো নেতাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। তাঁদের বদলে টিকিট পেয়ে যান রহিম নবি।
গোড়া থেকেই দলের অন্দরের উত্তাপ ভালই টের পেয়েছেন নবি। তাঁকে মেনে নিতে না পেরে সরাসরি বিরোধিতায় নেমেছিলেন ব্লক তৃণমূলের চার গুরুত্বপূর্ণ নেতা। পরে অবশ্য দলের চাপে নবির হয়ে মাঠে নামেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরা কতটা সামনে থেকে খেলবেন, সে প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে দলের অন্দরেই। নবি অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা সংবাদমাধ্যমের বানানো। আমরা সকলে একজোট হয়েই কাজ করছি।’’ একই দাবি অন্য তৃণমূল নেতাদেরও। দলের ব্লক সভাপতি আনিসুল ইসলাম বা পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী নেতা অসিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজনীতিতে অঙ্ক মেলানো কঠিন। রাজ্য জুড়ে তৃণমূল সরকারের কাজ দেখে মানুষ আমাদেরই সমর্থন করবেন।’’
নবির বিরুদ্ধে লড়াইতে কতটা তৈরি সিপিএম? বাম শিবিরের দাবি, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক আমজাদ গত পাঁচ বছরে জনসংযোগে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। আর পাঁচ জন বিধায়কের মতো এসি গাড়িতে চেপে নয়, বিধানসভায় আমজাদ যান লোকাল ট্রেনে চেপে। মনোনয়ন জমা করতেও যান একই ভাবে। আমজাদের দাবি, পাঁচ বছরে তিনি সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। বিধায়ক তহবিলের টাকায় পাণ্ডুয়া খেলার মাঠের এক দিকে গ্যালারি তৈরি করেছেন। শতাধিক পানীয় জলের কল বসিয়েছেন। পাঁচটি অ্যাম্বুল্যান্স দিয়েছেন। স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নে টাকা দিয়েছেন। বিভিন্ন পঞ্চায়েতে পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে। সিপিএম প্রার্থীর কথায়, ‘‘বিধায়ক তহবিলের পুরো টাকাই আমি কিন্তু এলাকার উন্নয়নে খরচ করতে পেরেছি। পাণ্ডুয়াবাসী সবই দেখেছেন।’’
তৃণমূলের পাল্টা দাবি, কয়েকটি বিষয় বাদ দিলে উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই করতে পারেননি আমজাদ। নবির টিপ্পনী, ‘‘পাণ্ডুয়ার মানুষ সিপিএম প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করছেন, কী কাজটা উনি করেছেন! বছরের পর বছর ধরে এই বিধানসভা কেন্দ্রে কোনও কাজ করেনি সিপিএম। আমরা ক্ষমতায় এলে দেখিয়ে দেব, সত্যিকারের উন্নয়ন আর পরিষেবা কাকে বলে!’’
সিপিএম-তৃণমূলকে টক্কর দিতে চেষ্টার কসুর করছেন না বিজেপি প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য। দীর্ঘদিনের আরএসএস কর্মী অশোকবাবুর এলাকায় ভাল পরিচিতি রয়েছে। তাঁর মিটিং-মিছিলেও লোক মন্দ হচ্ছে না। কিন্তু মানুষ কাকে ‘আশীর্বাদ’ করবে, তা অবশ্য ১৯ মে এলেই বোঝা যাবে। সে দিনই যে ভোট গণনা!
সহ-প্রতিবেদন: সুশান্ত সরকার।