সরকারি-বেসরকারি প্রচারে কোনও খামতি নেই। কিন্তু তাতে কি বিশেষ লাভ হচ্ছে? দশম শ্রেণির ছাত্র ঋষভ মণ্ডলের ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু সেই প্রশ্নটাকেই উসকে দিল। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার বা রেল লাইন পারাপার এবং রেল লাইন ধরে হাঁটতে গিয়ে গাড়ি চাপা বা ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকায় তা নিয়ে সতর্কতামূলক প্রচার চলে যথেষ্ট। কিন্তু সাধারণ যাত্রী বিশেষত স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের কানে যে তা পৌঁছয় না ঋষভের মৃত্যু তারই প্রমাণ। গত রবিবার সকাল ৭টা নাগাদ ডানকুনির একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রটি হাওড়া-বর্ধমান কর্ড শাখার বেলানগর স্টেশনের কাছে লাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী সে তখন মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। তাঁদের অনুমান, সেই কারণেই সম্ভবত সে ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পায়নি। তবে ঋষভের ঘটনাই নয়, দিন কয়েক আগে উত্তরপাড়া স্টেশনে সন্ধ্যায় একইভাবে মোবাইলে কথা বলার সময় রেল লাইন পার হতে গিয়ে এক ডাক্তারি ছাত্রী ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। সেই ঘটনাতেও এতটুকু সচেতনতা বাড়েনি রবিবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সেটাই প্রমাণ করল।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, যে দুর্ঘটনা একটু সচেতন হলেই এড়ানো সম্ভব তা উপেক্ষা করায় বার বার প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। তা সত্ত্বেও এই প্রবণতা রোখা যাচ্ছে না কেন? পাশাপাশি প্রতিটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই এক অদ্ভুত সমাপতন দেখা যাচ্ছে, অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা বিশেষত স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাই মোবাইল হাতে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
বস্তুত, আধুনিক প্রযুক্তির সূত্রে গত কয়েক বছরে অল্পবয়স্ক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মোবাইলের ব্যবহার প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে গিয়েছে। স্কুলের গণ্ডী না পেরেনো ক্লাস সেভেন, এইটের ছেলেমেয়েরা মোবাইল নিয়ে হোয়াটস অ্যাপ, ফেস বুক-এ অনায়াস বিচরণ করছে। এই আবহে স্কুলের তরফে এবং চিকিৎসকেরা অভিভাবকদের সচেতন হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের অভিমত, বাচ্চাদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা রাশ না টানলে এই জাতীয় প্রাণঘাতী ঘটনা রোখা যাবে না। পাশাপাশি মোবাইলের পথ বেয়ে বহু ক্ষেত্রেই অল্পবয়স্কদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনাও উডড়িযে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে প্রায়ই মোবাইলের কারণে দুর্ঘটনায় পড়ুয়াদের মৃত্যুতে অভিভাবকদের সঙ্গেই চিকিৎসকেরাও উদ্বিগ্ন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, বাচ্চাদের নানা অঘটন নিয়ে নাজেহাল অভিভাবকেরা নিয়মিত চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
উত্তরপাড়ার চিকিৎসক ঐশ্বর্য্যদীপ ঘোষ বলেন, ‘‘মোবাইলজনিত সমস্যা নিয়ে যে হারে বাচ্চারা আমার কাছে আসছে তা উদ্বেগের। ওদের মধ্যে আবেগ অনেক বেশি। এখন দেখা যাচ্ছে বহু ক্ষেত্রে মোবাইল এমনভাবে তাদের গ্রাস করছে, বাইরের জগৎ সম্বন্ধে সাধারণ বোধও তারা হারিয়ে ফেলছে। ফলে নিজেদের নিরাপত্তাও তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে।’’
দুর্ঘটনা বা মোবাইল জনিত নানা সমস্যা ঠেকাতে বাচ্চাদের মোবাইল দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অতিমাত্রায় সচেতন হতে পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। দুর্ঘটনা এড়াতে তাঁরা অভিভাবকদের সচেতনতাকেই ঢাল করতে চাইছেন। যদিও বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা বাস্তব কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। এমনকী অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের অসহয়তার কথাও জানিয়েছেন। রিষড়ার চারবাতি এলাকার এক অভিভাবক বলেন, ‘‘দিনকালের অবস্থা তো জানেন। আমার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। বিকেলে কোচিংয়ে পড়তে যায়। দেরি হলে চিন্তা হয়। তাই সঙ্গে মোবাইল ফোন দিয়েছি নিরাপত্তার কথা ভেবেই। এখন তার পরিণাম যদি এই-ই হয়, তাহলে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলব!’’
মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শশাঙ্কশেখর মণ্ডল বলেন, ‘‘স্কুলে মোবাইল ফোনের কোনও দরকার নেই। তাতে বরং পড়াশোনা থেকে মন সরে যায় পড়ুয়াদের। প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদের ভর্তির সময় মোবাইল ব্যবহার নিয়ে নিষেধাজ্ঞার মুচলেকা নেওয়া যেতে পারে। পড়ুয়াদের মোবাইল বন্ধ করতে বিদ্যালয় স্তরে ক্রমাগত নজরদারি চালানো দরকার। মোবাইল যখন ছিল না, বাবা-মায়েদের সঙ্গে কি ছেলেমেয়েরা যোগাযোগ করত না! না কি সময়ে বাড়ি ফিরত না!’’
মনোবিদ মোহিত রণদীপ এই সমস্যাকে আবার দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তাঁর কথায়, ‘‘উন্নত দেশগুলিতে ‘সেফটি এডুকেশন’ দেওয়া হয়। যাতে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। আমাদের সে সব বালাই নেই। অনায়াসেই আমরা হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মোবাইল ফোন কানে রাস্তা পার হই বা রেললাইন ধরে হাঁটি।’’ পাশাপাশি তাঁর যুক্তি, ‘‘অতিরিক্ত মোবাইল নির্ভরতা থেকেই আমাদের বোধ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। সেই কারণেই নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এর জন্য মানুষের চেতনা বাড়াতে সেমিনার বা ওই জাতীয় কর্মসূচী নেওয়া প্রয়োজন।’’