প্রতীকী চিত্র।
তেলঙ্গানায় পুলিশের ‘এনকাউন্টার’-এর পরে ধর্ষণ-খুনে অভিযুক্তদের মৃতদেহ পড়ে থাকার ছবি দেখাচ্ছিল টিভি। শুক্রবার দিনভর সেই ছবি থেকে চোখ ফেরাননি আমতার নতুনগ্রামের এক দম্পতি। সাতটা বছর পার। তাঁদের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তেলঙ্গানার ছবি দেখতে দেখতে তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘আমাদের মেয়ের ক্ষেত্রেও পুলিশ এমন করল না কেন? তা হলে এত বছর ধরে আমাদের মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হত না।’’
২০১২ সালে ওই দম্পতির একমাত্র মেয়ে তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। ৬ নভেম্বর সকালে সে পাশের গ্রাম পানশিলাতে টিউশন পড়তে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু আর বাড়ি ফেরেনি। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে তার বাবা-মা জানতে পারেন, মেয়ে শিক্ষকের পড়তে যায়নি। শুরু হয় খোঁজ। পানশিলার একটি ডোবায় গলায় তারই ওড়নার ফাঁস জড়নো অবস্থায় মেয়েটির মৃতদেহ মেলে।
পানশিলার যুবক সনাতন দলপতির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে তাদের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ওই দম্পতি। কারণ, সনাতন মেয়েটিকে সেই সময়ে বিয়ে করতে চাইলেও তার বাবা-মা রাজি হননি। তাঁরা জানিয়েছিলেন, সনাতন নিজের পায়ে দাঁড়ালে তবে, তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন। পুলিশের দাবি, গ্রেফতারের পরে জেরায় অপরাধের কথা কবুল করে সনাতন জানিয়েছিল, রাগ থেকেই সে মেয়েটিকে একটি পান-বরজের কাছে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করে। তদন্তে সহযোগিতা না-করার জন্য সনাতনের বাবা, ভাই এবং এক বন্ধুও গ্রেফতার হয়।
পুলিশ এই মামলার তদন্ত করে ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেয়। তারপর থেকে উলুবেড়িয়া মহকুমা পকসো আদালতে মামলাটি চলছে। সনাতন ছাড়া না পেলেও তার বাবা, ভাই এবং বন্ধু জামিন পেয়েছে। এই মামলায় মোট ১৭ জন সাক্ষী। বেশির ভাগেরই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়ে গিয়েছে। আর মাত্র দু’জনের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি। কিন্তু গত ছ’মাসেও সেই সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। কেন?
পুলিশের বক্তব্য, পকসো আদালতের বিচারক ছ’মাস আগে বদলি হয়ে গিয়েছেন। পরিবর্তে অন্য বিচারক বহাল হননি। তাই শুনানি বন্ধ রয়েছে। মেয়েটির বাবা জানান, গত ২৮ নভেম্বর শুনানির তারিখ ছিল। ওই তারিখ পর্যন্ত বিচারক যোগ দেননি। পরবর্তী তারিখ ফেলা হয়েছে আগামী ২৮ ডিসেম্বর।
বিচারের এই দীর্ঘসূত্রিতায় শুধু নিহত মেয়েটির বাবা-মা নন, হতাশ গোটা গ্রামও। তাঁদেরও প্রশ্ন, শেষ পর্যন্ত এই মামলার রায় হবে তো? মেয়েটি যে হাইস্কুলে পড়ত, সেখানে ওই গ্রামেরও বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ত। কিন্তু সেই ঘটনার পর ওই গ্রামের ছেলেমেয়েরা ওই স্কুলে আর যাচ্ছে না। প্রায় ৬ কিলোমিটার বাড়তি রাস্তা পার হয়ে তারা যাচ্ছে বাইনান বামনদাস হাইস্কুলে। এক অভিভাবক বললেন, ‘‘একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হল। তারপরেও দোষীদের কারও শাস্তি হল না। নির্জন ওই রাস্তা দিয়ে কোন ভরসায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাব?’’ নিহত মেয়েটির বাবা বলেন, ‘‘এক সময়ে আমি নিয়মিত আদালতে যেতাম। এত সময় লাগছে, বিরক্তিতে আর যাই না। আমার এক আত্মীয়ই মামলার তদ্বির করেন। রায় কবে দেখতে শুনতে পাব কে জানে? তেলঙ্গানায় যা হয়েছে সেটাই মনে হয় ঠিক।’’ মেয়েটির মা বলেন, ‘‘দোষী শাস্তি না-পাওয়ায় গোটা গ্রাম আতঙ্কে ভুগছে। য়ারা জামিন পেয়েছে, তারা বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমাদের বিদ্রুপ করে। ভয় লাগে।’’
স্থানীয় যুবক লালন ঈশ্বর এই ঘটনায় প্রথম থেকেই মেয়েটির পরিবারের পাশে আছেন। তিনি বলেন, ‘‘কাউকে পিটিয়ে মারা সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ধর্ষিতা মেয়েটির পরিবারেরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। অথচ, সাত বছর লড়াই করার পরেও কেন তাঁরা এখনও ন্যায়বিচার
পেলেন না তা প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার শীর্ষকর্তাদের খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।’’