এমনই হোমে দিন কাটছে কিশোরদের। ছবি: সুশান্ত সরকার
আলোচনার মাঝেই হোমের কর্তা এসে কাঁচুমাচু মুখে জানালেন, একটু আগে ২টো ছেলে পালিয়েছে। সবাই থ! বৈঠকে হাজির থানার বড়বাবু সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পাঠালেন হোমের এক কর্মীর সঙ্গে। আধ ঘণ্টা পরে এ যাত্রা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। পুলিশের তৎপরতায় ধরে আনা গেল ‘দামাল’ ছেলে দু’টিকে।
২৫ মে অর্থাৎ বুধবার ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল মিসিং চিল্ড্রেন ডে’। ওই দিনই আলোচনা চলছিল হুগলি জেলার কামারকুণ্ডু হোমে। গোটা জেলায় ছেলেদের জন্য একমাত্র হোম এটাই। সহায় সম্বলহীন বালক থেকে কিশোর অপরাধীদের ঠাঁই। কিন্তু হোমের এমনই ছিরি, এখান থেকেই ঘনঘন বাচ্চা ‘মিসিং’ হয়ে যায়, অভিযোগ এমনই। বলা বাহুল্য বৈঠক চলাকালীনই হাতেগরম প্রমাণও মিলে গেল। এই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, হোম কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবের দিকটি। সেই সঙ্গে সরকারি দফতরের সঙ্গে হোমের সমন্বয়ের অভাবও স্পষ্ট।
কামারকুণ্ডু স্টেশনের অদূরেই উচিৎপুর-গোপালনগর এলাকায় পিচ ছেড়ে মাটির রাস্তায় গেলেই ওই হোম। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই হোম। কিন্তু হোমের পরিবেশে কেমন আছে ছোটরা? সেই প্রশ্নই বারে বারে উঁকি দিয়েছে। বৈঠকে অবশ্য পরিকাঠামো ঢেলে সাজার ব্যাপারে নানা পরিকল্পনার কথা আলোচিত হল। বিভিন্ন সরকারি দফতর মিলে সার্বিক নজরদারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অভিযোগ, বরাবরই সবই শুধু আলোচনার পর্যায়ে থেকে যায়।
প্রশাসন সূত্রের খবর, হোমটি সাড়ে সাত দশকের পুরনো। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হোম পরিচালনা করে। কিন্তু এত দিনেও হোমের পরিকাঠামো কার্যত সেই তিমিরেই। বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন, পথশিশু, হারিয়ে যাওয়া শিশুদের আশ্রয় এই হোম। সঙ্গে চলছে বৃদ্ধাশ্রমও। আর একটি ঘরে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত অথবা সাজাপ্রাপ্ত কিশোরদের থাকার জায়গা। একই চৌহদ্দিতে বেসরকারি স্কুলও চলছে। সবক’টি জায়গায় যাওয়ার জন্য প্রবেশ পথ একটাই। প্রবেশ পথ বলতে বেড়ার গেট। নজরদারির বালাই নেই। যখন-তখন যে খুশি ঢুকে পড়তে পারে। হোমে কোনও সীমানা প্রাচিরই ছিল না। ফলে যে কোনও দিক দিয়ে যে কোনও সময় হোমে ঢোকা-বেরনো আদপেই কোনও সমস্যা ছিল না। বাচ্চাদের হাতে আঠার টিউব ঘোরে। উপযুক্ত কাউন্সেলিং হয় না বলে অভিযোগ। সরকারি হিসেব বলছে, চলতি বছরেই এই হোম থেকে ১০টি বাচ্চা পালিয়ে গিয়েছে। ৯টি নির্দিষ্ট মামলাও হয়েছে।
এই ছবিটা পাল্টাতে সম্প্রতি জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ (ডালসা) বিভিন্ন হোমে নজরদারি শুরু করে। আচমকা পরিদর্শনে এসে অনিয়ম, অব্যবস্থার এই চেহারা দেখলেন কামারকুণ্ডুর এই হোমে। এর পরেই শক্ত হাতে হোম পরিচালনায় তদারকি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন হোম পরিদর্শন কমিটির সদস্য তথা ডালসার সচিব সৌনক মুখোপাধ্যায়, তরুণ মুখোপাধ্যায়, জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক কাজল দত্ত, জেলা শিশু প্রোটেকশন অফিসার সুতপা চক্রবর্তী, প্রোটেকশন অফিসার প্রদীপ মল্লিক, ডিএসপি (ডিইবি) গোলাম মোস্তফা, সিঙ্গুর থানার ওসি সুখময় চক্রবর্তী, চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর গোপাবল্লভ শ্যামল প্রমুখ।
সূত্রের খবর, মাস কয়েক আগে হোম পরিদর্শন করে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ডালসার সদস্যদের। হোমের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা। এর পরেই তাঁদের তরফে হোমে সীমানা প্রাচীর তৈরি করতে চাপ দেওয়া হয় কর্তৃপক্ষকে। সম্প্রতি চারধারে পাঁচিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আধিকারিকরা অবশ্য মনে করছেন, পাঁচিল যথেষ্ট উঁচু করা হয়নি। অন্তত ১০ ফুট উঁচু পাঁচিল করে তার উপরে তারজালি দিয়ে ঘেরার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। হোমের খোলা ছাদ দেখেও চমকে ওঠেন সরকারি আধিকারিকরা। ছাদে বা বারান্দার ধারে রেলিংয়ের কোনও ব্যবস্থাই নেই। হোম কর্মীরা জানান, অনেকেই ছাদে উঠে হোমের পিছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে পা ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে।
সৌনকবাবু বলেন, ‘‘আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে এই হোমে নজরদারি রাখা হবে। এখানে বাচ্চারা যাতে উপযুক্ত পরিবেশে থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।’’ ডালসার পাশাপাশি সমাজকল্যাণ দফতর, চাইল্ড লাইনও বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নিয়মিত নজরদারি রাখবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে।