গত বছর হঠাৎ ঘোষণা হওয়া লকডাউনে চরম দুর্ভোগে পড়েন অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক। ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আসা সেরকমই এক পরিযায়ী শ্রমিকের দল। — ফাইল চিত্র।
গত বছরের লকডাউন-পর্বের দুঃসময় কাটিয়ে তাঁরা আবার কাজে থিতু হয়েছেন পুরনো জায়গায়। কিন্তু ফের ফেলে আসা সময় উঁকি দিচ্ছে মনে। ভিন্ রাজ্যে কাজের মাঝেই তাই দুশ্চিন্তায় হুগলির বহু পরিযায়ী শ্রমিক। অনেকে বলছেন, আবার টানা লকডাউন হলে আবার বাড়ি ফিরতে হতে পারে।
খানাকুলের নন্দনপুরের বছর চল্লিশের তারকনাথ দলুই গত দু’দশক ধরে কর্নাটকের ম্যাঙ্গালোরে সোনার কারিগর। গত বছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি কয়েক দিনের জন্য খানাকুলে গিয়েছিলেন। তার মধ্যেই লকডাউন হয়ে যায়। খানাকুলে ১০০ দিন প্রকল্পের কাজ পর্যন্ত জোটেনি। তারকের কথায়, ‘‘আমার জবকার্ড নেই। মায়ের জবকার্ডের সঙ্গে আমার নাম জুড়ে দিতে চেয়েছিলাম। হয়নি। বসে বসে জমানো টাকায় খেয়েছি। আমাদের রেশন কার্ডও বড়লোকের। অথচ একফালি চাষজমিও নেই।’’ সাত মাস বাড়িতে থাকার পরে তারক ম্যাঙ্গালোরে ফেরেন। জমে যাওয়া বাড়ি ভাড়া শোধ করেন ধার করে।
কিন্তু আবারও বিপত্তি। বেঙ্গালুরু-সহ ওই রাজ্যের নানা জায়গায় করোনার প্রকোপ বেড়েছে। রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কার্ফু চলছে। তাঁর কথায়, ‘‘শুনছি লকডাউন হবে। সত্যিই হলে কী করব, চিন্তার বিষয়।’’
হরিপালের পানিশেওলার তাপস স্বর মুম্বইয়ের জুহুরি বাজারে গয়না কারখানার শ্রমিক। স্ত্রী এবং ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে সেখান থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে ভাইন্দারে ভাড়া থাকেন। কয়েক দিনের ‘নাইট-কার্ফু’র পরে এখন লকডাউন চলছে। প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে হচ্ছে সকাল ১০টার মধ্যে। আশপাশে থাকা পশ্চিমবঙ্গের বহু শ্রমিক বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। তাপস জানান, তাঁর কারখানা খোলা। তাঁর কথায়, ‘‘কারখানায় কম কাজ হচ্ছে। কাঁচামাল শেষ হয়ে গেলে তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিক্রিবাট্টা বন্ধ থাকায় মাল জমছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, দেখা যাক!’’ গত বছর লকডাউনের সময় তিনি কষ্টেসৃষ্টে মুম্বইতেই থেকে গিয়েছিলেন।
গুপ্তিপাড়ার পাটমহলের শেখ সাহিদুল গুজরাতের আমদাবাদে সোনার কাজ করেন। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সেখানে রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কার্ফু চলছে। গত বছর লকডাউন শেষ হতে ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরেছিলেন সাহিদুল। ১০০ দিনের কাজ করেন। তাঁর বক্তব্য, ওই কাজ করে সংসার চলে না। তাই গুজরাতে ফিরে গিয়েছেন। সাহিদুল বলেন, ‘‘গত বছর লকডাউনের সময় বাড়ি ফিরিনি যদি রাস্তায় বেরোলে পুলিশ মারে, সেই ভয়ে। তবে খুব সমস্যা হয়নি। কারখানা মালিক খাওয়ার খরচ জুগিয়েছিলেন। আমরা কয়েক জন মিলে ভাড়া থাকি। ভাড়াবাড়ির নীচে রেশন দোকান থেকে খাদ্যসামগ্রী পেয়েছিলাম। স্থানীয় বাসিন্দারাও সাহায্য করেছিলেন।’’
তাঁর কথায়, ‘‘আগের বছরের মতো লকডাউনের কথা ভেবে অনেকে ফিরে গিয়েছেন। বাজারে গিয়ে শুনছি, এখানে-ওখানে করোনা ছড়িয়েছে। কিন্তু আমরা যেখানে আছি, সেখানে ততটা হয়নি। আমি এখন বাড়ি ফেরার কথা ভাবছি না। ফিরতে টাকা দরকার। গেলেও হয়তো বসে খেতে হবে। যদি দীর্ঘ লকডাউন হয়, সে ক্ষেত্রে ভাবতে হবে।’’
গুজরাতের রাজকোটে পাথর সেটিংয়ের কাজ করেন গুপ্তিপাড়ার সাকির শেখ। কুড়ি বছরের যুবকটি গত বছর করোনা-পর্বে মাস পাঁচেকের জন্য বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু ১০০ দিনের প্রকল্প ছাড়া অন্য কাজ জোটেনি। ফলে ফের তাঁর ঠিকানা হয়েছে রাজকোট। তাঁরও এখনই বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা নেই। তবে, তিনিও পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
তারকনাথ থেকে সাকির— প্রত্যেকেরই আক্ষেপ, নিজের এলাকায় একটা ভাল কাজ পেলে অন্য রাজ্যে এসে কাজ করতে হত না।