Death

‘গাছ রয়ে গেল, আমার ভাইটাই শুধু চলে গেল!’

প্রায় ১০ মাস আগের সেই ঘটনা আজও তাড়া করে বেড়ায় সুশান্ত সিংহরায় ও বিজলিদেবীকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২১ ০৬:২৪
Share:

সুকান্ত সিংহরায়

‘স্ট্র্যান্ড রোডে রেলের বহুতলে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। কয়েক জন দমকলকর্মীর মৃত্যুর আশঙ্কা!’ সোমবার রাতে টিভিতে খবরটা দেখেই চমকে উঠেছিলেন তারকেশ্বরের বাসিন্দা বৃদ্ধ দম্পতি। চকিতে চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ছোট ছেলের মুখটা।

Advertisement

২০২০ সালের ২৭ মে। জি টি রোডে বিদ্যুতের তারের উপরে ভেঙে পড়েছিল গাছের ডাল। সেটি কাটতে গিয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল বালি দমকল কেন্দ্রের কর্মী সুকান্ত সিংহরায়ের। প্রায় ১০ মাস আগের সেই ঘটনা আজও তাড়া করে বেড়ায় সুশান্ত সিংহরায় ও বিজলিদেবীকে। আর তাই টিভিতে স্ট্র্যান্ড রোডের ঘটনা দেখেই বার বার ফোন করে খবর নিয়েছিলেন বড় ছেলে সুদীপ্ত সিংহরায়ের। তিনি তারকেশ্বর দমকল কেন্দ্রের কর্মী। মঙ্গলবার সুদীপ্ত বলেন, ‘‘প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না বাবা-মা বার বার কেন ফোন করছেন। পরে মোবাইলে খবরটা দেখে বুঝতে পারি কেন ওঁরা এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। মন খারাপ হয়ে যায়। আমার ভাইটাও তো এমন কাজ করতে গিয়েই মারা গিয়েছিল।’’

ছেলেকে হারানোর যন্ত্রণা আরও উস্কে দিচ্ছিল স্ট্র্যান্ড রোডের খবরটা। তাই বাড়ি ফিরেই বাবা-মাকে টিভির সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। শুধু তা-ই নয়, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মনটা একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখতে এ দিন সকালেই তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কিছুটা দূরে, কাকার বাড়িতে। কিন্তু ভাইয়ের স্মৃতিই ঘুরছে সুদীপ্তর নিজের মনেও। তিনি বলেন, ‘‘জানেন, ভাই আমার থেকে চাকরিতে সিনিয়র ছিল। ২০১৬-য় অগজ়িলিয়ারি ফায়ার পার্সোনেলের চাকরি পেয়েছিল। চার বছরেই সব শেষ।’’

Advertisement

২৭ মে-র ভোরের কথা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে সুদীপ্তের স্ত্রী সুতপারও। একমাত্র দেওরের আবদারে আলুর তরকারি তৈরি করে, মুড়ি-সহ ভরে দিয়েছিলেন টিফিন কৌটোয়। সুতপা বলেন, ‘‘নিজের টিফিন ছাড়াও সহকর্মীদের জন্য হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে দিতে বলেছিল। সেটাও কৌটোয় ভরে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম পকেটে বিস্কুট রাখতে। খিদে পেলেই জল-বিস্কুট খেতে।’’ বৌদির থেকে টিফিন নিয়ে মোটরবাইকে চেপে বালির দমকল কেন্দ্রে কাজে যোগ দিতে এসেছিলেন সুকান্ত। দুপুর ১টা নাগাদ বেরিয়ে যান গাছের ডাল কাটার কাজে। সেই সময়ে তারকেশ্বরের বাড়িতে সবে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন সুদীপ্তেরা সকলে। তখনই বালি থেকে ফোন করে জানানো হয়, দুর্ঘটনায় পড়েছেন সুকান্ত। তাঁরা যেন দ্রুত সেখানে পৌঁছন।

তড়িঘড়ি সুশান্তবাবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সুদীপ্ত। রাস্তাতেই আসে সুতপার ফোন। জানতে পারেন, ভাই আর নেই। বালিতে এসে সুকান্তের নিথর দেহ দেখেন তাঁরা। আজও প্রতি পদে বাড়ির ছোট ছেলের অভাব অনুভব করে সিংহরায় পরিবার। ঘটনার পরে মানসিক ভাবে খুবই ভেঙে পড়েছেন বিজলিদেবী। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল করতেন সুকান্তই। আজও বাড়িতে একসঙ্গে পাঁচ-ছ’টি হাঁসের ডিম সিদ্ধ করতে গেলে চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না সুতপা।

লকডাউনের সময়ে দেওর আর বৌদি মিলে ইউটিউবে মোচার চপ বানানো শিখেছিলেন। সুকান্তর নিজের লাগানো কলাগাছের মোচা কেটে তা দিয়ে চপ বানিয়ে সকলকে খাইয়েও ছিলেন। ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে সুদীপ্তর চোখ ভিজে যায়। কোনও মতে নিজেকে সামলে তিনি বলেন, ‘‘গাছ রয়ে গেল, আমার ভাইটাই শুধু চলে গেল!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement