গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘‘স্রোতের টান আছে। তাড়াতাড়ি কর। এ বার ষোলোটা ছাড়। তিনটে ল্যাজার পাঠাস,’’— নদীর পারে দাঁড়িয়ে ফোনে কাউকে এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে উঠে পড়লেন বেঁটেখাটো শীর্ণ চেহারার তামাটে বর্ণের মধ্যবয়সি শামসুল আলি (নাম পরিবর্তিত)। হাত-পায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। চুল ভেজা। পরনের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। আঠালো কাদায় দু’পা মাখামাখি! দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বৃষ্টির জলে ভরে ওঠা ওই নদীর জলে বার কয়েক ডুব দিয়েছেন শামসুল। এই শামসুলেরাই সেই লাইনম্যান, যাঁদের হাত ধরেই বর্ষাকালে কৌশল বদলে অবাধে গরু পাচার হয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির সীমান্ত দিয়ে! আর এই লাইনম্যানদের সঙ্গত করে কমবয়সি ‘ল্যাজারেরা’। যাঁদের কাজ গরুর সঙ্গে থাকা। লেজ নাড়িয়ে গরুকে সঠিক নদীপথ চেনানো।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) অবশ্য এই কারবার সম্পর্কে অবগত। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি একে আর্য বলেন, ‘‘বর্ষায় নদীপথে গরু পাচার রুখতে স্পিডবোডে টহলদারি বাড়ানো হয়। কৌশল বদলে পাচারের ঘটনা ঘটলে বিএসএফ পাল্টা কৌশলে তা আটকেও দেয়।’’
জলঙ্গির অলিগলিতে কান পাতলে শোনা যায়, সীমান্তবর্তী গ্রামের বহু মানুষই গরু পাচারের কারবারের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের কেউ লাইনম্যান, কেউ আবার ল্যাজারের কাজ করেন। বাড়তি রোজগারের আশাতেই বর্ষার দু’মাস এই কারবারে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। স্থানীয় সূত্রে খবর, সাধারণত গ্রামের একটু বয়স্ক ‘অভিজ্ঞ’ লোকেদেরই লাইনম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ, দীর্ঘ দিন ধরে এলাকায় থাকার ফলে সীমান্ত এলাকাকে হাতের তালুর মতো চেনেন তাঁরা। ওই শামসুলদের মতো লাইনম্যানদের হাতেই থাকে সীমান্ত টপকে বাংলাদেশে গরু পাচারের মূল দায়িত্ব। নদীপথের কোথায় কাঁটাতার নেই, কোথায় জওয়ানদের টহলদারি চলছে, এই সব খবরাখবর তাঁদেরই রাখতে হয়। শুধু তা-ই নয়, বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে ঠিক কখন নদীতে দৃশ্যমানতা কমে আসে এবং সেই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কী ভাবে বিএসএফের নজর এড়িয়ে গরু পাচার হবে, তার পরিকল্পনাও ছকে দেন এই লাইনম্যানেরাই। আর এই কাজের জন্য দিনের শেষে তাঁরা পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।
পাচার হয়ে যাচ্ছে গরু। —নিজস্ব চিত্র।
কারবারিদের একাংশের সূত্রে জানা যায়, বর্ষায় প্রতি রাতে ছোট ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে ১০-১২টি গরু ফরাজিপাড়ায় নিয়ে আসা হয়। বড় ট্রাক হলে ১৮-২২টি করে গরু। তার পর সেই গরুগুলিকে কখনও এক দিন, কখনও আবার দিন দুয়েক মতো গ্রামের অস্থায়ী খামারে রেখে তৈরি হয় পাচারের নকশা। দাবি, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ‘হাতে রাখা’র দায়িত্বও পড়ে লাইনম্যানদের উপর। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীর চোরাস্রোতে সাঁতরে গরুকে ও পারে পৌঁছে দেন ল্যাজারেরাই। নজরদারি একটু ঢিলেঢালা হলেই পাল পাল গরু একেবারে পাঠানো হয় বাংলাদেশে।
তবে মাঝেমাঝে নদীপথে নজরদারি বাড়ায় বিএসএফ। কারবারিদের সূত্রে খবর, সেই সময় পাচারের নকশাই বদলে ফেলেন লাইনম্যানেরা। সীমান্তে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া আছে, সেখানে জলনিকাশি কালভার্টের সহায়তা নেওয়া হয়। গোল পাইপের কালভার্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় গরুকে। গলায় বাঁধা থাকে দড়ি। ও পার থেকে সেই দড়ি ধরে গরুকে টেনে বার করে নেওয়া হয়। অনেক সময়, চরের মধ্যে দিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে জলে নামিয়ে দেওয়া হয় গরুদের। গরুও জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে যায় ও পারে। সে সব ক্ষেত্রে অবশ্য গরুর পিঠে একটি বিশেষ নম্বর থাকে। ওই নম্বর দেখে ও পারে যে যার গরু শনাক্ত করে নিয়ে যান। এই সময়ে এ পার এবং ও পারের কারবারিদের মধ্যে মোবাইলেই চলে খবরের আদানপ্রদান।
যদিও কোন কৌশলে গরু পাচার হবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে বিএসএফের নজরদারির উপর। রাজ্য জুড়ে গরু পাচার নিয়ে শোরগোলের আবহে তা ইদানীং বেড়েওছে বলে জানালেন শামসুল। নদীর জলে কাদামাখা হাত-পা ধুতে ধুতে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এ সব করতে হয়। কী করব! টাকার দরকার। এই বর্ষাকালেই কিছু টাকা হাতে আসে। সিভিকদের এখন রমরমা বাজার। ঝুঁকি কমাতে ওদের ৫০-১০০ টাকা করে দিতে হয়। পার্টির লোক, ক্লাবের ছেলেদেরও কিছু দিতে হয়। তবুও তো বিএসএফের গুলিতে মারা পড়তে হয়।’’
স্থানীয় সূত্রে দাবি, গত মাসেই বিএসএফের গুলিতে আকবর আলি নামে স্থানীয় এক ল্যাজারের প্রাণ গিয়েছে। সেই আকবরের পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘‘অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ। নিষেধ করতাম আমরা। শুনতই না। বলত, ‘এই দু’মাস করব। তার পর ছেড়ে দেব।’ ওরা (ল্যাজার) ছাড়তে চাইলেও লাইনম্যানেরা ওদের ছাড়তে চায় না। পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। সব ক্ষমতা তো ওদেরই হাতে।’’