আমপানে ক্ষতি হলেও সরকারি ক্ষতিপূরণ মেলেনি এই পান-বরজের জন্য। অভিযোগ নন্দীগ্রামের কেন্দেমারি এলাকার বাসিন্দা পিন্টু মণ্ডলের। নিজস্ব চিত্র
ভেঙেছে ঘর। ত্রাণ নিয়ে বিতর্ক। ভোটের মুখে আমপান বিধ্বস্ত এলাকার ছবি
সে ঝড় বয়ে গিয়েছে গত মে মাসে। কিন্তু এখনও ‘আমপান’-এর দৌলতে তৈরি অনেক ফাটল বোজেনি নন্দীগ্রামে।
ঝড়ে এলাকায় বহু বাড়ি ভেঙেছে। পানের বরজ চুলোয় গিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুমুল। তাতে যাঁরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, তাঁরা এক ধাপে রয়েছেন। যাঁরা পাননি, তাঁরা অন্যত্র। যাঁরা সে সব নিয়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমেছেন, তাঁরাও নানা কারণে নানা স্তরে দাঁড়িয়ে। তবে ‘আমপান’-এর পরে, ত্রাণ বণ্টনের প্রশ্নে চাপান-উতোরের রেশ আসন্ন বিধানসভা ভোটে পড়বে, এ কথা মানছে সব পক্ষই।
হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে আমপান ক্ষতিপূরণ বিলিতে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে ‘সিএজি’ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল)। ‘প্রকৃত’ ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই বাড়ি তৈরির টাকা এখনও পাননি, পানের বরজ এবং মৃত গবাদিপশুর ক্ষতিপূরণ নিয়ে বেনিয়ম হয়েছে, একই পরিবারের একাধিক সদস্য ত্রাণের টাকা পেয়েছেন বলে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের প্রাথমিক তদন্তের পরে, বেশ কয়েকজন ক্ষতিপূরণপ্রাপক টাকা ফেরত দিয়েছেন। সে বাবদ প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে বলে দাবি প্রশাসন সূত্রের। ‘সিএজি’ অবশ্য আলাদা তদন্ত করছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের পূর্ব মেদিনীপুরেই থাকার কথা।
‘সিএজি’ কী করে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই পিন্টু মণ্ডলের। কেন্দেমারি পঞ্চায়েত এলাকার জালপাইয়ের এই বাসিন্দা জানান, আমপানের দিন তাঁর মাটির ঘরের ছাদ উড়ে গিয়েছিল। গাছ পড়ে মাটিতে মিশে যায় তাঁর সাড়ে তিন হাজার বাংলা পাতার পানের বরজ। পান বিক্রি করে সংসার চালানো পিন্টু এখন ইটভাটায় শ্রমিক। চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছেন বরজ ঠিক করাতে। তাঁর দাবি, ‘‘প্রশাসনের থেকে কিছু পাইনি। শুভেন্দুদা ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। দাদা যে দিকে, আমরা সে দিকে।’’
পিন্টুর পড়শি রাধারানি মাইতি, একই পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা জন্মেজয় রঞ্জিতেরা কেউ সরকারি আবাস প্রকল্পে বাড়ি না মেলার অভিযোগে ক্ষুব্ধ, কেউ রাজনীতির রং বিচারের কারণে ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ না পাওয়া বা ভাতা না পাওয়ার নালিশে না-খুশ। এমনকি, হালের ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিও কাছে পৌঁছয়নি, দাবি তাঁদের। জেলাশাসক বিভু গোয়েল অভিযোগ মানেননি। তাঁর বক্তব্য ‘‘সরকারি ত্রাণ বিলি-সহ অন্য সব বিষয়ে কার, কী অভিযোগ, তা নির্দিষ্ট ভাবে তালিকা করে জানালে, তদন্তের পরে ব্যবস্থা হবে।’’
মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে। নন্দীগ্রাম ২ ব্লকের খোদামবাড়িতে এক কামরার টালির চালের মাটির ঘরে স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে বাস বীরেশ মাইতির। দুর্ঘটনায় কর্মশক্তি হারানো মানুষটির সংসার চলে স্ত্রীর দিনমজুরির পারিশ্রমিকে। ‘আমপান’ দিয়েছিল ঘর তছনছ করে। বীরেশবাবু জানাচ্ছেন, অতি দ্রুত ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা মেলায় ঘর খাড়া করতে অসুবিধা হয়নি। দাবি করছেন, ‘‘শুধু আমি নয়, আমার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পড়শিও বেঁচে গিয়েছেন দরকারে সরকার পাশে দাঁড়ানোয়।’’
তবে সর্বত্র পরিস্থিতি তেমন নয়। এলাকা থেকে ত্রাণ বিলিতে বহু অভিযোগ পেয়ে নন্দীগ্রামের কেন্দেমারি পঞ্চায়েতের প্রধান মনসুরা বিবিকে পদত্যাগ করতে বলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তিনি তা করেন। কিন্তু পরে, পদ ফেরতও পান। এলাকাবাসীর একাংশ মনসুরার ‘চালিকাশক্তি’ বলে মনে করেন তাঁর স্বামী তথা কেন্দেমারি পঞ্চায়েতের সদস্য শেখ শাহবুদ্দিনকে। তিনি পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। দাবি করছেন, ‘‘এখানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা ত্রাণ পাননি, এমন নয়। দ্রুত ত্রাণ পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে দু’-একটা গণ্ডগোল হতে পারে। কিন্তু সে সময় শুভেন্দুবাবু ছিলেন দায়িত্বে।’’
নন্দীগ্রামে তৃণমূলের পরিচিত মুখ আবু তাহেরও দাবি করছেন, শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘ধাপ’ ছিল ‘আমপান’। কেন? তাহেরের জবাব, ‘‘উনি সরকারের দেওয়া ত্রাণ বিলিতে পুরোভাগে থাকলেন। আবার আলাদা ভাবে ত্রাণ বিলি করে বাহবা কুড়োলেন।’’ শুভেন্দুর থেকে বছর দু’য়েকের বড় এই নেতার সংযোজন, ‘‘উনি আমাদের কাঁধে ভর দিয়ে উপরে উঠে, পরের ধাপে যাওয়ার রাস্তা করছিলেন। এখন দল বদলে নানা প্যাঁচ কষে আমাদের বিপদে ফেলতে চাইছেন। তবে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোদ নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। শুভেন্দুর জারিজুরি খাটবে না।’’
তৃণমূল-শিবিরের অভিযোগ, এলাকায় আমপানের ত্রাণ বিলির প্রশ্নে শুভেন্দুর নেতৃত্বে বিজেপি সম্প্রদায়ের তাস খেলছে। প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে ত্রাণের সুবিধা পাওয়ার নিরিখে সংখ্যালঘুরা অন্যদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছেন— এমন ‘তত্ত্ব’। প্রবণতা হিসেবে, যা ‘বিপজ্জনক’। বিজেপি নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, ত্রাণ-দুর্নীতিতে তৃণমূলের উপরে ভরসা হারিয়েছেন নন্দীগ্রামের অনেকে। তা ঢাকতে, তৃণমূল অজুহাত খাড়া করছে।
বহু বার চেষ্টা করলেও ফোন ধরেননি শুভেন্দু। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের জবাব দেননি। তবে আমপান যখন নন্দীগ্রামে ধাক্কা মারে তখন তৃণমূলের নন্দীগ্রাম ১ ব্লক সভাপতি, বিজেপিতে গিয়েও শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মেঘনাদ পাল বলছেন, ‘‘তৃণমূলে থাকাকালীন শুভেন্দু যা করেছেন, তা দলের নির্দেশে। উনি ব্যক্তিগত ভাবে ও সব করলে, গোটা রাজ্য থেকে ত্রাণ বিলিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠত না।’’ কেন্দেমারি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য শেখ শাহবুদ্দিনের বাড়ির কাছেই হোসেনপুরে অস্ত্র কারখানার হদিস মিলেছে মনে করিয়ে বিজেপির তমলুক সাংগঠনিক জেলা সহসভাপতি প্রলয় পাল জুড়ছেন, ‘‘ওই অস্ত্র কারখানা তৃণমূলের ‘ভোটে খেলা হবে’ ঘোষণার সঙ্গে জড়িত। আগের ধাপ।’’
‘ফাটল’ কিন্তু বিজেপির অন্দরেও আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক নেতার বক্তব্য, পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য করতে গিয়ে সন্ত্রাস, লোকসভা ভোটে গা-জোয়ারি এবং আমপানের ত্রাণ বিলির দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অনেকে এখন তাঁদের সহকর্মী। কিন্তু বিধানসভায় ভোট চাইতে জনতার দুয়ারে এক সঙ্গে দাঁড়াতে তাঁদের অস্বস্তি হবে। ‘দলের পুরনো লোক’ বলে পরিচিত এক নেতার কথায়, ‘‘জয় শ্রী রাম বললেই সাত খুন মাফ হয় না।’’ বিভাজন অস্পষ্ট নয়।