এসএসকেএমে বন্ধ। ন্যাশনালে বিভাগই নেই। এ বার নীলরতন সরকারেও যন্ত্র অকেজো হয়ে গেল। ভরসা শুধু কলকাতা মেডিক্যাল আর আরজিকরের টেলিথেরাপি ও ব্র্যাকিথেরাপি-র একটি করে যন্ত্র। ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে এসে হাপিত্যেশ করে বসে থাকা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এ রাজ্যে।যেমন বাঁকুড়ার শালতোড়ার আবুল শেখ। মাসে অন্তত দু’বার একে-তাকে ধরে জেলা থেকে কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ঘুরতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে তাঁর। ক্যানসার রোগী আবুল রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল থেকে নিখরচায় কেমোথেরাপি পেয়েছেন। ডাক্তারবাবুরা জানিয়েছিলেন, পরের ধাপেই রেডিওথেরাপি দরকার।
জেলায় সেই ব্যবস্থা নেই। অতএব ভরসা শুধু কলকাতাই। কিন্তু সেখানে ‘ডেট’ পড়েছে চার মাস পরে। তত দিন কি চিকিৎসা না করিয়ে পড়ে থাকবেন তিনি? যে সরকার কেমোথেরাপির দামি ওষুধ নিখরচায় দিতে পারে, সেই সরকার কেন যন্ত্রণাকাতর ক্যানসার রোগীকে রেডিওথেরাপি দিতে পারে না, বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের দরজায় দরজায় ঘুরেও এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।কেন ঘুরতে হচ্ছে তাঁকে? কারণ, ক্যানসারের চিকিৎসা যতই জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হোক না কেন, রোগীদের রেডিওথেরাপি এখনও পুরোপুরি কলকাতার উপরেই নির্ভরশীল। আর সেই কলকাতাতেই একাধিক মেডিক্যাল কলেজে রেডিওথেরাপির যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। ঘর তৈরি হয়ে পড়ে থাকা সত্ত্বেও কেনা হচ্ছে না লিনিয়র অ্যাক্সিলরেটর যন্ত্র। ফলে কোথাওই রোগীর চাপ কমছে না। কেউ অর্ধেক চিকিৎসা করিয়ে বসে রয়েছেন। কারও বা মূল চিকিৎসাই রেডিওথেরাপি।কিন্তু সেটাই হচ্ছে না। মুমূর্ষুকেও চিকিৎসার ডেট দেওয়া হচ্ছে ছ’-সাত মাস পরে। অপেক্ষা করতে করতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে অজস্র।রাজ্যের সরকারি ক্যানসার চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ এ জন্য দায়ী করেছেন, স্বাস্থ্যকর্তাদের পরিকল্পনাহীনতাকে। তাঁদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী শুধু কেমোথেরাপি ফ্রি দেওয়ার কথা বলেননি। সামগ্রিক ভাবে ক্যানসার চিকিৎসাকেই সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে বলেছিলেন। রেডিওথেরাপি ছাড়া যা অসম্পূর্ণ।বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, সাধারণ ভাবে রেডিয়েশন দেওয়ার পদ্ধতি দু’রকমের। টেলি থেরাপি আর ব্র্যাকিথেরাপি। টেলি থেরাপির ক্ষেত্রে যন্ত্রটি দূর থেকে রোগীর শরীরের নির্দিষ্ট অংশে রশ্মি প্রবেশ করায়।
আর ব্র্যাকিথেরাপি হল যেখানে তেজস্ক্রিয় শলাকা শরীরের নির্দিষ্ট অংশে লাগিয়ে রেডিয়েশন দেওয়া হয়। শুধুমাত্র জরায়ু মুখের মতো নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসারের ক্ষেত্রেই ব্র্যাকিথেরাপি দেওয়া চলে। গোটা রাজ্যে এই মুহূর্তে দু’টি টেলি থেরাপি এবং দু’টি ব্র্যাকিথেরাপি যন্ত্র কাজ করছে। যে রাজ্যে প্রতি বছর ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন, সেখানে এই পরিকাঠামো যে নগণ্য, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সকলেই।সমাধান কী? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, টেলি কোবাল্ট যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এখানে তলানিতে। সেটা ঠিকঠাক করা জরুরি। কিন্তু ওই যন্ত্রের যে রেডিয়েশন সোর্স, তা কয়েক বছর অন্তর বদলাতে হয়। বহু সময়েই তা হয় না বলে মাসের পর মাস যন্ত্র অকেজো পড়ে থাকে। তাতে অনেক সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া ওই পদ্ধতিও এখন পুরনো। রোগীর দেহের ক্যানসার আক্রান্ত অংশের একেবারে নির্দিষ্ট জায়গায় রেডিয়েশন দেওয়ার জন্য দরকার লিনিয়র অ্যাক্সিলরেটর নামে একটি যন্ত্র। সোর্স বদলানোর ব্যাপার নেই। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে লিনিয়র অ্যাক্সিলরেটর বসানোর জায়গা তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু যন্ত্র কেনা হচ্ছে না। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও যন্ত্র বসানোর জায়গা রয়েছে। কেনা হয়নি সেখানেও।স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কেনার কথা এগিয়েছিল। তার পরে ভোট এসে যাওয়ায় সব ধামা চাপা পড়ে যায়। আবার প্রক্রিয়া শুরু হবে।’’ কিন্তু ভোট মিটেছে, নতুন সরকারের বয়সও দু’মাস পেরিয়ে গেল। এখনও সেই বকেয়া কাজটা হল না কেন? টাকার অভাব? তিনি বলেন, ‘‘না, টাকা এই মুহূর্তে কোনও সমস্যা নয়।’’ তা হলে সমস্যাটা কী? সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলেনি। তিনি বলেছেন, ‘‘সমন্বয়ের সমস্যা হচ্ছে। সেটা কাটিয়ে উঠে মাস কয়েকের মধ্যেই নতুন যন্ত্র বসবে।’’কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলি ঘুরে দেখা গিয়েছে, প্রত্যেক হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন দেড়শো থেকে ২০০ ক্যানসার রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। ভিড় সবচেয়ে বেশি কলকাতা মেডিক্যাল এবং আরজিকরে। সেখানকার ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষায় রাখতে রাখতে তাঁরা প্রতিনিয়ত বিবেক দংশনে ভুগছেন। মেডিক্যালের রেডিওথেরাপির প্রধান শ্যামল সরকার জানান, তাঁদের একটি কোবাল্ট যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। তার পরিবর্তে লিনিয়র অ্যাক্সিলরেটর বসার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। অন্য সমস্ত পরিকাঠামো তৈরি। আরজিকরের রেডিওথেরাপির প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেমোর ক্ষেত্রে আধুনিক ওষুধ নিখরচায় দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে আমরা এখনও ৩০ বছর পিছিয়ে আছি। যত দ্রুত এই পরিস্থিতি কাটানো যাবে, যত দ্রুত লিনিয়র অ্যাক্সিলরেটর বসবে, ততই রোগীদের ভোগান্তি কমবে।’’