উচ্ছ্বাস। ফল প্রকাশের পরে রামনগর হাই মাদ্রাসায় ছবিটি তুলেছেন সাফিউল্লা ইসলাম।
প্রথম দশের পাঁচ জনের সাকিন মুর্শিদাবাদ। আলিম পরীক্ষাতেও দ্বিতীয় হয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে। শুক্রবার প্রকাশিত হাই মাদ্রাসার ফলে জেলারই রমরমা।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ফল ভাল হয়েছে নদিয়াতেও। মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের সচিব সৈয়দ নুরুস সালাম জানান, এ বছর প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের পড়ুয়াদের ফল ভাল হয়েছে। পর্ষদ প্রকাশিত মেধা তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে মুর্শিদাবাদের পাঁচ পড়ুয়ার নাম রয়েছে। মাদ্রাসা বোর্ডের সভাপতি ফজলে রাব্বি জানান, মুর্শিদাবাদের ১০,৫১৪ জন ছাত্রছাত্রী এ বছর হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় বসেছিল। উত্তীর্ণ হয়েছে ৭,৮০৫ জন। এ বছর মুর্শিদাবাদের পড়ুাদের সাফল্যের হার বেশ ভাল। মেধা তালিকার উপরের দিকে জেলার বেশ কয়েকজন পড়ুয়া রয়েছে। নিতান্তই দারিদ্র সীমার নীচের পরিবার থেকে উঠে এসে ওই পড়ুয়ারা সফল হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামের এই পড়ুয়ারা কার্যত নিজেদের চেষ্টায় ও শিক্ষকদের সাহায্যে এই সাফল্য অর্জন করেছে।
৭৪৭ পেয়ে রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে দৌলতবাদের গঙ্গাপ্রসাদ হাই মাদ্রাসার সাবির আহমেদ। চতুর্থ হয়েছে রানিনগরের আমিরাবাদ হাই মাদ্রাসার ছাত্রী মুস্তিকা খাতুন। তার প্রাপ্ত নম্বর ৭৪৩। ৭৪১ নম্বর পেয়ে রাজ্যের মধ্যে পঞ্চম হয়েছে রামনগর হাই মাদ্রাসার গোলাম সারওয়ার সরকার। রাজ্যের মধ্যে যুগ্ম ভাবে দশম হয়েছে জেলার দুই ছাত্র। ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসার মহম্মদ ইউসুফ জামান এবং লালগোলা আইসিআর হাই মাদ্রাসার মহম্মদ হাবিবুল্লা—যুগ্ম ভাবে দশম হয়েছে। দু’জনেরই প্রাপ্ত নম্বর ৭২৬।
জেলার সেরা হওয়ার খবর মিলতেই সাবিরের পরিবারে আনন্দের জোয়ার। পড়শি সকাল থেকেই তাদের বাড়িতে ভিড় করছেন। সাবির তার এই সাফল্যের পুরো কৃতিত্বই দিচ্ছে মাদ্রাসার শিক্ষকদের। কোনও বাঁধাধরা নিয়মে সে পড়াশোনা করেনি। তবে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি সব কিছুকে উপেক্ষা করে নিয়ম স্কুলে যেত সাবির। তার কথায়, ‘‘আমার এই সাফল্যের স্কুলের শিক্ষকদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।’’ সাবির জানায়, পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকেই শিক্ষকরা কয়েকজন উৎসাহী পড়ুয়াকে নিয়ে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করেন। সেও নিয়মিত ওই ক্লাসগুলি করত। শিক্ষকদের সার্বিক সহায়তায় এই সাফল্য এসেছে। ছেলের সাফল্যের মধ্যেও বাবা আব্দুল হান্নানের কপালে অবশ্য চিন্তার ভাঁজ। হান্নানের সম্পত্তি বলতে মেরেকেটে বিঘে খানেক জমি। তা থেকে যা আয় তাতে সংসার চলে না। ফলে দিন গুজরান করতে অন্যের জমিতে দিনমজুরি করতে হয়। পড়াশোনার ফাঁকে সাবিরও বাবাকে সাহায্য করে। টানাটানির সংসারে তার কেবল অঙ্ক ও ইংরেজির গৃহশিক্ষক ছিল। সাবির স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়া। প্রত্যন্ত গ্রামে মানুষের কষ্ট লাঘব করতে চায় সে।
জেলার আর এক কৃতী গোলাম সারওয়ার সরকারের রানিনগরের বাবলাবোনা গ্রামের বাসিন্দা। সারওয়ারও ছোট থেকেই টানাটানির সংসারে বড় হয়েছে। বাবা গোলাম হোসেন পেশায় প্রান্তিক চাষি। সারওয়ারের মাত্র দু’টি বিষয়ে গৃহশিক্ষক ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাকে ক্লাসের পরও সাহায্য করতেন। সারওয়ার ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চায়। তাঁর কথায়, ‘‘স্রেফ অভাবের কারণে গ্রামের অনেকেই মাঝপথে স্কুল-ছুট হয়ে যায়। শিক্ষক হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’’
চাষির ছেলে হাবিবুল্লা সকালে বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ সেরে স্কুলে যেত। তারপর আবার রাত জেগে পড়াশোনা। অনটনের সংসারে কাজ সেরে পড়াশোনা করতে হয়েছে হাবিবুরকে। লালগোলার প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও লোকজনকে কার্যত বিনা চিকিৎসায় ভুগতে হয়। হাবিবুল্লা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়।
জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম মুস্তিকার পরিবার অবশ্য আর্থিক ভাবে সচ্ছল। বাবা রবিউল হাসান পেশায় রেশন ডিলার। রানিনগরের সেনপাড়ার মুস্তিকা ইতিমধ্যেই হাওড়ার আল আমিন মিশনে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনার সঙ্গে খেলাধুলোতেও পারদর্শী মুস্তিকা। সদ্য সমাপ্ত সারা বাংলা মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দীর্ঘ লম্ফনে সে তৃতীয় হয়েছে। তার ইচ্ছা বড় হয়েছে প্রশাসনিক বিভাগে যোগ দেওয়া।
শুধু হাই মাদ্রাসায় নয়, মাদ্রাসা শিক্ষক পর্ষদ প্রকাশিত আলিমের ফলেও এ দিন তাক লাগিয়েছে মুর্শিদাবাদ। মাটির দেওয়াল আর টালির চালার কুড়েঘরে কুপির আলোয় পড়ে মাদ্রাসা বোর্ডের আলিম (মাধ্যমিক সমতুল) পরীক্ষায় রাজ্যে দ্বিতীয় হয়েছে বেণীপুর গ্রামের আব্দুল জাব্বার। ভূমিহীন দিনমজুর শেখ মহম্মদ আলির ছেলে জাব্বারের প্রাপ্ত নম্বর ৮০২। ইসলামপুরের পমাইপুর ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার ছাত্র জাব্বার।
অন্যদিকে নদিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার থানারপাড়া এইচএম হাই মাদ্রাসার পড়ুয়া মুবিন গেফারি ৭১০ পেয়েছে। বাবা মুস্তাক হোসেন পেশায় মুদির দোকানদার। বকুলতলা গ্রামেই ছোট মুদির দোকান চালিয়ে কোনওরকমে চার জনের সংসার চালাতে হয় মুস্তাককে। এরই মধ্যে ছেলের সাফল্যে উদ্বেলিত মুস্তাক। তবে চিন্তাও যেন কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁকে।
আর মুবিনের কথায়, সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। চাপড়ার বেলতলা হাই মাদ্রাসার ছাত্রী আরাধনা খাতুন ৬৬৬ পেয়েছে। সে তার স্কুলের সেরা হয়েছে। ওই মাদ্রাসার সহ শিক্ষক আব্দুল রহিম জানান, আরাধনা নিয়মিত ক্লাস করত। পরিশ্রমের ফল পেয়েছি সে।