থামেনি বৃষ্টি, ভয় কাটছে না পাহাড়ের

টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের ধস-পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের রাস্তায় বৃহস্পতিবারও কয়েক দফায় ধস নেমেছে। বারে বারে তা সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে প্রশাসন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতের আতঙ্ক এখনও কাটেনি।

Advertisement

কিশোর সাহা ও রেজা প্রধান

মিরিক শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৪
Share:

ধস-দুর্গতদের চেক বিলি মুখ্যমন্ত্রীর। বৃহস্পতিবার মিরিকের টিংলিংয়ে রবিন রাইয়ের তোলা ছবি।

টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের ধস-পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের রাস্তায় বৃহস্পতিবারও কয়েক দফায় ধস নেমেছে। বারে বারে তা সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে প্রশাসন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। দিনভর পাহাড়ের হাট-বাজার প্রায় ফাঁকা ছিল। ম্যাল চৌরাস্তায় পর্যটক প্রায় দেখাই যায়নি। বরং বাস, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে সমতলে ফেরার জন্য ভিড় ছিল বেশি। সন্ধ্যার পরে বৃষ্টি একটু কমতে রাস্তায় গাড়ির লাইন পড়ে যায়। রাত পর্যন্ত পাহাড়ের পথে সারি সারি গাড়ির লাইন দেখা গিয়েছে। রোহিণীতে প্রায় দু’হাজার গাড়ি আটকে ছিল অনেক রাত পর্যন্ত।

Advertisement

নতুন করে কোনও প্রাণহানির খবর বৃহস্পতিবার মেলেনি। তবে কালিম্পঙের কোলাখাম এলাকায় একটি বস্তিতে ধসে আরও অন্তত ৩ জন মঙ্গলবার রাত থেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে খবর মিলেছে। সব মিলিয়ে এখনও ১৪ জন নিখোঁজ। উদ্ধারকারীরা তাঁদের এক জনকেও খুঁজে না পাওয়ায় পাহাড়বাসীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

ধসে দুর্গতদের অনেকেরই অভিযোগ, একে প্রবল বৃষ্টিতে কাজে বিঘ্ন ঘটছে, তার উপরে ভিআইপি সামলাতে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ ব্যস্ত থাকায় এ দিন উদ্ধারের কাজের গতি বুধবারের চেয়ে কমে গিয়েছিল। মিরিকের ধস-বিধ্বস্ত টিংলিঙের বাসিন্দাদের কয়েকজন ত্রাণ শিবিরে দাঁড়িয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, নিখোঁজদের সন্ধান কবে মিলবে? নিমা লামা, প্রেমা শর্মার মতো দুর্গতরা জানাচ্ছেন, যদি কেউ আহত হয়ে পড়ে থাকেন, তা হলে এই বৃষ্টিতে তিনি আরও মাটি-পাথরের নীচে চলে যাবেন। তাঁকে বাঁচানো দায় হবে। তাই প্রশাসনের উচিত অন্য সব কাজ ফেলে এখন নিখোঁজদের সন্ধান করা। কিন্তু তাঁরা ব্যস্ত ভিআইপিদের সফর তদারকি করতেই। তবে দার্জিলিং জেলা পুলিশ-প্রশাসনের দাবি, ত্রাণের কাজ গুরুত্ব দিয়েই করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরের জন্য কাউকে ব্যতিব্যস্তও হতে হয়নি। যা শোনার পরে পুলিশ-প্রশাসনের অন্য অংশ মুচকি হেসেছেন।

Advertisement

তবে পাহাড়বাসীদের অনেকেই মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে চলে আসায় আশ্বস্ত বোধ করছেন। তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা যে খবর পেয়েই চলে এসেছেন, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তাঁদের ভরসা আরও বেড়েছে এদিনই মুখ্যমন্ত্রী টিংলিঙে গিয়ে ত্রাণ শিবিরের ৪টি দুর্গত পরিবারের হাতে ৪ লক্ষ টাকা করে ১৬ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ তুলে দেওয়ায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘মৃত ও আহতদের পরিবার যাতে দ্রুত টাকা পায়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ সেই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দুর্গতরা যত দিন খুশি ত্রাণ শিবিরে থাকবেন। তাঁদের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার।’’

এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছেন দুর্গতদের অনেকেই। তাঁরা জানান, ধসে যে সব বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে, তাঁদের অন্যত্র ঘর তৈরি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সে জন্য সরকারি ভাবে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জিটিএ-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যৌথ ভাবে সব কাজ হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

এই ভাবে একযোগে কেন্দ্র-রাজ্য-জিটিএ-র কাজ করার কথা শুনেও আশার আলো দেখছেন দুর্গতেরা। দুপুরে কালিম্পঙে গিয়ে রিজিজুও জানিয়ে দেন, রাজ্যের সঙ্গে মিলেই জিটিএ এলাকার বিপর্যয়ের মোকাবিলায় সব রকম সাহায্য করছে কেন্দ্র। পুনর্নির্মাণের জন্য কেন্দ্র দলও পাঠাবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীও পাহড়ের ধস-পরিস্থিতি সংক্রান্ত সমীক্ষার জন্য জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সহযোগিতা চাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।

তবে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কোনও বড় নেতাকে দেখা না গেলেও রিজিজুর পাশেই দেখা গিয়েছে বিমল গুরুঙ্গকে। এমনকী, তাঁকে শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে রাতেই মোর্চার প্রথম সারির নেতা বিনয় তামাঙ্গকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গুরুঙ্গ। জিটিএর অন্যতম কর্তা তথা মোর্চা নেতা রোশন গিরি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন। আমাদের জিটিএ-র প্রধান সচিব সহ অফিসাররা গিয়েছিলেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এটা রাজনীতির সময় নয়। এখন সকলে মিলে কাজ করছি। সেটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই বলেছেন। কাজেই এখন বির্তক বাড়িয়ে লাভ নেই।’’


রাতেও চলছে ধস সরানোর কাজ। কিছু ক্ষণ ধরে রাস্তা সারাই করার পরে কিছু

সংখ্যায় গাড়ি ছাড়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার কার্শিয়ঙের কাছে। ছবি: সন্দীপ পাল।

পাহাড়বাসীও রাজনীতিতে উৎসাহী নয়। পরিজনদের মৃত্যুর খবর পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাঁদের স্বজনেরা। মিরিকের টিংলিঙের বাসিন্দা মনীষা শর্মার বিয়ে হয়েছে শালবাড়িতে। ধসের খবর পেয়ে গাড়ি ভাড়া করে বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখেন বাড়িটার অস্তিত্বই নেই আর। তাল তাল আঠালো মাটি পড়ে রয়েছে শুধু। বাবা, ভাই, বোন কারও হদিসই নেই। সে দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মনীষা। মিরিক হাসপাতালে চিকিৎসার পরে তিনি এখন টিংলিঙের ত্রাণ শিবিরে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আরও দুই বোন মায়া ও সঞ্জনা। তাঁদের পরিবারের ৫ জনের দেহ মিলেছে। ৬ জনের কোনও হদিস বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মেলেনি। তিন বোন একে অন্যকে জড়িয়ে মাঝে মধ্যেই ফুঁপিয়ে উঠছেন।

যে হারে বৃষ্টি চলছে তাতে পাহাড়ের শঙ্কাও বাড়ছে। বিপর্যয় মোকাবিলার কাজে তাই গতি আনার দাবিতে সরব হচ্ছেন তাঁরা। তাঁরা যে জানেন, পাহাড়ে বর্ষা ফুরোতে এখনও প্রায় তিন মাস বাকি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement