প্রার্থী তালিকা নিয়ে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে বচসা। রবিবার সিউড়িতে তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
পদ্ম এখনও পূর্ণ বিকশিত নয়। তার আগেই ভ্রমরদের ভিড় উপচে পড়ছে! তার জেরে অশাম্তি শেষ পর্যন্ত গড়াচ্ছে দলীয় দফতরের বাইরে বিক্ষোভ, ভাঙচুর পর্যন্ত। যার ফলে পুরভোটের আগে অস্বস্তি বাড়ছে বিজেপি নেতৃত্বের।
পদ্ম শিবিরের যখন এই হাল, জোড়া ফুল শিবিরের ছবিও কিছু আলাদা নয়। সেখানেও মন্ত্রী থেকে বিধায়ক, বা দলের রাজ্য নেতা, ক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছেন অনেকেই। সেই সঙ্গেই বাড়ছে বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকদের নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে শিলিগুড়ি থেকে বর্ধমান, আরামবাগ থেকে উলুবেড়িয়ায়। বিজেপির প্রার্থী তালিকা নিয়েও তেমনই জেলার পাশাপাশি খাস কলকাতা শহরে বিক্ষোভ চলছে। শহরের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী নিয়ে রবিবার বিক্ষোভ হয়েছে বিজেপির রাজ্য দফতরের সামনে।
হার-জিতের সম্ভাবনা যেমনই হোক, প্রার্থী হওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি এবং তার জেরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দক্ষিণপন্থী দলে পরিচিত ঘটনা। এই পুরভোট ঘিরেই দলীয় অসন্তোষে কলকাতায় ১০ বছর আগে প্রবল হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পরে সেখানেও এমন ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েক বার। রাজ্যের এখনকার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এক বার টিকিট না পেয়ে স্বয়ং দলনেত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে বিক্ষোভ দেখাতে লোক পাঠিয়েছিলেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সংগঠন-নির্ভর দল বলে বিজেপিকে এ সবের চেয়ে কিঞ্চিৎ আলাদা করে রাখতেন কেউ কেউ। কিন্তু এ বারের পুরভোট ঘিরে বিক্ষোভের ঢেউ অতীতের কংগ্রেস বা পরবর্তী কালের তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির প্রভেদের দেওয়াল ভেঙেই দিচ্ছে বলা যায়!
উত্তরবঙ্গ ও কলকাতার মতো বীরভূমেও প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিজেপির সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। রবিবার সেটাই চরম আকার নিয়েছে। সিউড়ি শহরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে থাকা দলীয় কার্যালয় থেকে বিজেপির সিউড়ি ও সাঁইথিয়া পুরসভার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল এ দিন। কিন্তু টিকিট প্রত্যাশীদের তুমুল বিক্ষোভের জেরে তালিকা প্রকাশ করতে পারেননি বিজেপির বীরভূম জেলা পর্যবেক্ষক রামকৃষ্ণ পাল। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে দলীয় কার্যালয়ে বসে রামকৃষ্ণবাবু এবং দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য সুকুমার দাস শেষ পর্যায়ের আলোচনা সেরে নিচ্ছিলেন। বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন উৎসুক কর্মীরা। যাঁদের একটা বড় অংশ কিছু দিন আগেও তৃণমূলে ছিলেন। বিজেপি সূত্রের খবর, সমস্যা তৈরি হয় দলের বহু দিনের নেতা তথা প্রাক্তন জেলা সভাপতি নির্মল মণ্ডল ওই আলোচনায় যোগ দিতে চাইলে। দীর্ঘ ক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করেও ঢুকতে না পেরে বর্ষীয়ান ওই নেতার উষ্মা দেখে বাইরে উপস্থিত কর্মীদের একাংশ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কার্যালয়ের ভিতরেও ঢুকে পড়েন বেশ কিছু কর্মী। স্লোগান দিয়ে বিক্ষুব্ধেরা চেয়ার টেবিল উল্টে দেন। শুরু হয় ভাঙচুর।
পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে দেখে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা বিরত রেখে বাইরে বেরিয়ে আসেন রামকৃষ্ণবাবু। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই রামপুরহাট থেকে আসা জনা কয়েক বিজেপি কর্মী-সমর্থকও পর্যবেক্ষককে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তাঁদের ক্ষোভ, শনিবার রামপুরহাট পুরসভার জন্য প্রকাশিত তালিকা মোটেই আশানুরূপ হয়নি। পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে দলের তরফে রামপুরহাটের পর্যবেক্ষক সত্যেন দাসের বিরুদ্ধে স্লোগানও দিতে শুরু করেন তাঁরা। ওঠে টাকা নিয়ে টিকিট দেওয়ার অভিযোগও। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সিউড়ির তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া সিউড়ি পুরসভার কাউন্সিলর নেতা দীপক দাস এবং কালোসোনা মণ্ডলেরা রামকৃষ্ণবাবুকে গাড়িতে তুলে দেন। তিনি বোলপুরের দিকে চলে যান। পরে রামকৃষ্ণবাবু বলেন, “একই আসনের জন্য একাধিক নাম এসেছে। তাই মতের অমিল থাকতেই পারে। তবে, যিনি যোগ্য তিনিই প্রার্থী হবেন। তবে এখনও প্রার্থী তালিকাই ঘোষিত হয়নি। কারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, জানি না।” আর এই গোলমালের মধ্যেই বিজেপির বীরভূম জেলা সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন দুধকুমার মণ্ডল।
প্রার্থী তালিকা নিয়ে নানা জেলায় উপর্যুপরি বিক্ষোভকে অবশ্য চিন্তার কারণ বলে মনে করছে না বিজেপি। বরং, দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন বলেন, “বিক্ষোভ দল বড় হওয়ার লক্ষণ। সাধারণ মানুষ ও কর্মীদের প্রত্যাশার প্রমাণ। তবে কোথাও বিক্ষোভ যাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে না যায়, তা দেখতে হবে। অনেক সময় ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা করার লোক ঢুকে পড়ে। তেমন কোথাও হচ্ছে কি না, সেটাও নজরে রাখছি।” যা শুনে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় হাসতে হাসতে বলেছেন, “বেশি বিক্ষোভ মানে বেশি বড় দল তা হলে! বেশ, বেশ!”
তাঁদের দলে পরিস্থিতি অনেক নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই দাবি পার্থবাবুর। কলকাতার বাইরে অন্যান্য জেলার ৯৩টি পুরসভার জন্য প্রার্থী তালিকায় রাজ্য নেতৃত্বের অনুমোদন দেওয়ার পর্বও এ দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জেলায় জেলায় উঠে আসা ছবি তৃণমূল নেতৃত্বের দাবির সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে না! বর্ধমানের দাঁইহাটে এ দিনই দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন পূর্বস্থলী উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও। বিক্ষুব্ধদের দাবি, দাঁইহাট পুর-এলাকার তৃণমূল নেতারা মিলে যে তালিকা পাঠিয়েছিলেন, তা বদলে গিয়েছে। দাঁইহাট শহর তৃণমূলের সভাপতি তথা ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী রঞ্জিত কুমার সাহার দাবি, “কর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রার্থী বদল না হলে আমিও প্রার্থী হব না!” দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভে আটকে থেকে এক সময় বিধায়ক তপনবাবু বলে ফেলেন, “এ ভাবে আমাকে ডেকে এনে হেনস্থা করার মানে কী? আপনাদের উদ্দেশ্যটাই বা কী? আপনারা জেলা সভাপতিকে পুরো বিষয়টি জানান।” তপনবাবু জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথকে ফোনে সব জানান। পরে অবশ্য বিধায়ক বলেন, “জাতীয়তাবাদী দলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকবেই। ঠিক সময়ে সব মিটে যাবে।”
শিলিগুড়িতে তৃণমূলের বিক্ষোভও অব্যাহত। প্রার্থী নিয়ে এ দিনও দলীয় কর্মীদের একাংশের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা দলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেব। শিলিগুড়ির ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ওই তৃণমূল কর্মীরা ‘বহিরাগত’ প্রার্থীকে মানা হবে না বলে এ দিন বিক্ষোভ দেখান। পরে দলীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে বিক্ষোভে জানাতে যান কলেজপাড়ায় মন্ত্রীর বাড়ির সামনে। মন্ত্রী তখন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী, তাঁর স্ত্রী শুক্লাদেবীকে নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন। মন্ত্রীকে বাড়ির সামনে পেয়ে গিয়ে রাস্তাতেই প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন ওই কর্মীরা। অস্বস্তিতে পড়ে এলাকায় দলের নির্বাচনী কার্যালয়ে সকলকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন গৌতমবাবু। যত ক্ষণ আলোচনা চলে, বাইরে দলের পতাকা নিয়েই পার্টি অফিস ঘেরাও করে রাখেন ক্ষুব্ধ কর্মীরা। তাঁদের দাবি নিয়ে ফের আলোচনার আশ্বাস দিলে আধঘণ্টা পরে বিক্ষোভকারীরা শান্ত হয়ে চলে যান। বিজেপি-র রাহুলবাবুর মতোই গৌতমবাবুরও দাবি, “এত বড় দল। কর্মী সমর্থকদের আবেগ তো থাকবেই। কেউ প্রার্থী হতে না পারলে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তবে সময় যেতে দিন, দেখবেন সকলে ফের একসঙ্গে কাজ করছে।” মন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “ক্ষোভ-বিক্ষোভের ঘটনা বেশ উপভোগ করছি! বুঝতে পারছি সকলের আমার প্রতি কতটা প্রত্যাশা রয়েছে। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হলাম।”
যার যত বিক্ষোভ, সে ততই বড়! অস্বস্তিতে পড়ে এই ব্যাখ্যাই এখন দিচ্ছে পদ্ম এবং জোড়া ফুল শিবির!