হাতে যা জমি রয়েছে, তার অর্ধেকই বে-হাত হয়ে গিয়েছে। বাকিটুকু যাতে রক্ষা করা যায়, এ বার বিজ্ঞপ্তি জারি করে সব সরকারি দফতর ও জেলা প্রশাসনকে সে ব্যাপারে সক্রিয় হতে বলল নবান্ন।
কী বলা হয়েছে তাতে? সম্প্রতি রাজ্য কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের সচিব মনোজ অগ্রবাল ওই নির্দেশিকায় বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন দফতর ও তার অধীন অফিসগুলির হাতে যে জমি রয়েছে, তা চিহ্নিত করে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে। সাধারণ মানুষের জ্ঞাতার্থে প্রয়োজনে পাঁচিলের গায়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিতে হবে। নির্দেশিকা পেয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, দফতরগুলিকে তা এক মাসের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
কেন এই নির্দেশ? নবান্নের এক শীর্ষকর্তার ব্যাখ্যা, এর মূল উদ্দেশ্য হল, এখনও সরকারের হাতে যতটা ফাঁকা জমি রয়েছে, তা দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করা। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারি জমির একটা বড় অংশ দখলদারদের হাতে চলে গিয়েছে। তা উদ্ধার করাও কার্যত অসম্ভব। তাই হাতে থাকা খালি জমিতে নতুন করে দখল আটকানো নিশ্চিত করতেই পাঁচিল দিতে বলা হয়েছে।’’
উদ্যোগ আসলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একাধিক দফতরের সচিবরা জানিয়েছেন, ইদানীং জেলার প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতে নিয়ম করে সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, পথ নিরাপত্তা, জমির জবরদখল নিয়ে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার বক্তব্য হল, তাঁরা এত কষ্ট করে, ধার-দেনা করে সরকার চালাচ্ছেন। আর সরকারের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। তাঁর প্রশ্ন, কেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? কেন সরকারি জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হবে না? জমিতে কেউ বসলে তখনই কেন তুলে দেয় না পুলিশ? মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, এ সব চলবে না। জমি রক্ষা করতেই হবে। তিনি যেমনটা চেয়েছেন, তেমন নির্দেশই প্রশাসনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
নিজেদের হাতে ঠিক কত খালি জমি রয়েছে— ‘জমি ব্যাঙ্ক’ তৈরির জন্য তা নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল রাজ্য সরকার। তাতে যে ছবি উঠে এসেছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বছর চারেক আগে করা ওই সমীক্ষায় বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার একর জমি রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই দখল হয়ে গিয়েছে। আর ফাঁকা জমির পরিমাণ মাত্র ৬০ হাজার একর। ভূমি দফতরের এক কর্তা জানান, গত চার বছরে ফাঁকার তালিকায় সামান্য কিছু জমি যুক্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই সময়ে নতুন করে জবরদখলও হয়েছে কিছু জমি। তাই হরেদরে ব্যবহারযোগ্য জমির পরিমাণ মোট জমির ১০-১২ শতাংশের বেশি হবে না। পুনরায় দখল আটকাতে এই জমিই এখন ঘিরে রাখতে চাইছে সরকার।
কিন্তু নির্দেশিকাকে ঘিরে একাধিক দফতর ও জেলা-প্রশাসনের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ভূমি দফতরের বক্তব্য, সরকারের বেশি জমি রয়েছে সেচ, পূর্ত ও সড়ক, পঞ্চায়েত এবং স্বাস্থ্য দফতরের হাতে। তাদের বক্তব্য, এক সময়ে রাস্তা তৈরি বা নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্য অনেক জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। তার অনেকটাই ফাঁকা পড়ে থাকলেও কী ভাবে রাস্তার দু’ধার বা চর এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সম্ভব? একই ভাবে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল তৈরি করতে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণ জমি স্বাস্থ্য দফতরের হাতে তুলে দিয়েছেন গ্রাম-শহরের মানুষ। সেই সব জমির অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে হাসপাতালের ভিতরে। তা-ই বা কী করে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সম্ভব?
পরিস্থিতিটা যে জটিল, তা মানছেন নবান্নের কর্তারা। তবে তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর মূল বক্তব্য হল, সরকারের জমি রক্ষা করতে হবে। তা সে যে ভাবেই হোক। কিন্তু সেটা মুখের কথায় সম্ভব নয়। তাই পাঁচিল দিয়ে ঘেরার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যাতে জবরদখলকারীরা বুঝতে পারে, ওটা সরকারি জমি।
জবরদখলের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তার মোকাবিলা হবে কোন পথে— তা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না সরকারি আধিকারিকরা। যেমন, হাওড়া জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ভবানী দাস জানান, সার্কুলার হাতে পেয়ে জেলার ছ’টি গ্রামীণ হাসপাতাল ও ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফাঁকা জমি চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু জবরদখল জমি কী করে উদ্ধার হবে, তা জানতে স্বাস্থ্যভবনকে চিঠি দেব। একই সুর শোনা গিয়েছে সেচ, সড়ক, পঞ্চায়েতের মতো কয়েকটি দফতরের কর্তাদের মুখেও।
রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা অবশ্য মনে করেন, অধিকাংশ জবরদখলের পিছনে রয়েছে রাজনীতিকদের লম্বা হাত। তাঁদের মদতেই জেলাগুলিতে একের পর এক সরকারি জমি দখল হয়ে গিয়েছে। এই দখল সরাতে বাম আমল থেকে বহু বার সক্রিয় হয়েছে প্রশাসন। কিন্তু ভোটের কথা মাথায় রেখে কোনও দলই দখলকারীদের সরাতে সাহস দেখায়নি। ঠিক যে কারণে কলকাতার ফুটপাথ এখনও দখল হয়ে রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘তাই মুখ্যমন্ত্রী চাইলেও এখন যা অবস্থা তাতে সরকারি জমি থেকে দখলদার সরাতে গেলে অনেক জায়গায় ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে যেতে পারে। কারণ, বহু মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে যুক্ত।’’
এই সমস্যার কথা জানেন নবান্নের কর্তারা। তাই জবরদখল হটাতে পদক্ষেপ করার জন্য ওই বিজ্ঞপ্তিতে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি— জানান ভূমি দফতরের এক কর্তা। বরং এখনও যে টুকু সম্বল রয়েছে, তা কী ভাবে রক্ষা করা যায়, সেটাকেই মূল মন্ত্র করেছে সরকার।