(বাঁ দিকে) শপথগ্রহণ করতে চেয়ে ধর্নায় দুই বিধায়ক। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যের দুই বিধায়কের শপথগ্রহণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, বৃহস্পতিবার তার নিষ্পত্তি করে দিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস নিজেই। জানিয়ে দিলেন, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রায়াত হোসেন সরকারের শপথগ্রহণে কোনও বাধা নেই। কারণ, ওই দায়িত্ব তিনি দিচ্ছেন ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। তাঁর উপস্থিতিতে বিধানসভাতেই শপথ নিতে পারবেন দুই বিধায়ক। কিন্তু বিধানসভা সূত্রে খবর, আশিস ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, এই দায়িত্ব তিনি নিতে চান না। ফলে শপথগ্রহণ নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা থাকছে।
সংবিধান অনুযায়ী, ভোটে জেতার পর নবনির্বাচিত বিধায়কেরা শপথগ্রহণ করেন রাজ্যপালের উপস্থিতিতে। তিনি কাউকে এই কাজে নিযুক্ত করলে, তাঁর উপস্থিতিতেও শপথগ্রহণ সম্ভব। সেই নিয়ম অনুযায়ী ডেপুটি স্পিকারকে দায়িত্ব দিলেন রাজ্যপাল।
স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি রাজভবন থেকে কোনও চিঠি পাননি। তাই এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারবেন না। তবে রাজভবন সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার কলকাতা ফিরে বিকেলেই রাজ্যপাল দুই বিধায়কের শপথের দায়িত্ব ডেপুটি স্পিকারকে দিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। সেখানেই সায়ন্তিকারা শপথ নিতে পারেন।
লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে এ বার রাজ্যের দুই বিধানসভা কেন্দ্র বরাহনগর এবং ভগবানগোলায় উপনির্বাচন হয়েছে। বরাহনগরে জিতেছেন সায়ন্তিকা। ভগবানগোলা থেকে জিতেছেন রায়াত। কিন্তু এখনও তাঁরা বিধায়ক হিসাবে শপথগ্রহণ করতে পারেননি।
দীর্ঘ দিন ধরেই সায়ন্তিকারা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তাঁরা রাজভবন নয়, বিধানসভায় শপথ নিতে চান। রাজ্যপাল বিধানসভায় এসে তাঁদের শপথগ্রহণ করাতে পারেন। অথবা, তিনি অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দিতে পারেন। স্পিকার বিমানকে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু রাজভবনের তরফে এ বিষয়ে অনড় মনোভাব দেখানো হয়েছিল। রাজ্যপাল দিল্লিতে চলে গিয়েছিলেন। বিধানসভায় ধর্নায় বসেছিলেন সায়ন্তিকারা। পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হচ্ছিল। এর মাঝে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে নতুন করে জলঘোলা শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন রাজ্যপাল।
বৃহস্পতিবার এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেছেন রাজ্যপাল। সেখানে সংবিধান ধরে ধরে দেখানো হয়েছে, বিধায়কদের শপথগ্রহণে রাজভবন এবং বিধানসভার কী ভূমিকা। তার পর রাজ্যপাল জানিয়েছেন, তিনি বিধায়কদের শপথ বাক্য পাঠ করানোর দায়িত্ব দিচ্ছেন ডেপুটি স্পিকারকে।
উল্লেখ্য, বিধায়কদের শপথগ্রহণ নিয়ে জটিলতার মাঝে শুক্রবার বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকেছিলেন স্পিকার। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘শুক্রবারের অধিবেশন ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল।’’ তাঁর মন্তব্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। বিধানসভা সূত্রে খবর, শপথগ্রহণের জটিলতা নিয়ে আইনি পরামর্শে জানা গিয়েছে, রাজ্যপালের হাতে বিধায়কদের শপথগ্রহণের চাবিকাঠি থাকলেও ‘বিশেষ অধিবেশন’ ডেকে উপনির্বাচনে জয়ীদের শপথগ্রহণ করানো যায়। শুক্রবার শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালকে বাদ রেখে বিধায়ক হিসাবে সায়ন্তিকাদের শপথগ্রহণ করানোর পরিকল্পনা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। তা যদি হত, তবে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা ঘটতে পারত। অনেকের মতে, তার আগে বৃহস্পতিবারই রাজ্যপাল ডেপুটি স্পিকারকে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়ায় সেই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কিন্তু এখানেও সমস্যা রয়েছে। অতীতে বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে জয়ী বাবুল সুপ্রিয়ের শপথগ্রহণ নিয়ে জট তৈরি হওয়ার পর তৎকালীন রাজ্যপাল শপথগ্রহণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ডেপুটি স্পিকার আশিসের হাতে। কিন্তু তিনি বেঁকে বসেছিলেন। জানিয়েছিলেন, এই দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম। তখন রাজ্যপাল সিদ্ধান্ত বদল করে বাবুলের শপথের দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্পিকারকে। এ ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না, সেটা দেখার।
নিয়ম অনুযায়ী, আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর থেকে দু’টি পৃথক চিঠি পাঠানো হয় বিধানসভা এবং রাজ্য সরকারের কাছে। ওই চিঠিতে জয়ীদের সম্পর্কে তথ্য জানানো হয় দু’পক্ষকে। এর পরেই সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের পরিষদীয় দফতর রাজভবনকে চিঠি দিয়ে জয়ীদের শপথগ্রহণের বিষয়ে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করে। সেই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু গোল বাধে তার পরেই। নিয়ম অনুযায়ী, এর পরে রাজ্যপাল স্পিকারকে শপথগ্রহণ করানোর দায়িত্ব দিতে পারেন। রাজ্যপাল যদি চান, তিনি নিজেও বিধায়কদের শপথগ্রহণ করাতে পারেন। নতুবা তাঁর ‘মনোনীত’ কেউ বিধায়কদের শপথগ্রহণ করাতে পারেন। এই দু’জনের ক্ষেত্রে পরিষদীয় দফতর রাজভবনকে চিঠি দেয়নি। তার বদলে স্পিকার রাজভবনকে চিঠি দিয়ে দুই বিধায়কের নির্বাচিত হওয়ার কথা জানিয়ে তাঁদের শপথগ্রহণ করানোর অনুরোধ করেন। এর পর রাজভবনের তরফে আলাদা আলাদা করে সায়ন্তিকা ও রায়াতকে চিঠি দিয়ে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে রাজভবনে গিয়ে শপথগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দু’জনেই পাল্টা রাজভবনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁরা রাজভবন নয়, বিধানসভায় শপথগ্রহণ করতে চান। চাইলে রাজ্যপাল বিধানসভায় এসে তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করাতে পারেন। কিন্তু রাজভবন তাতে সাড়া না দেওয়ায় বিধানসভায় ধর্না অবস্থান শুরু করেন দুই হবু বিধায়ক। রাজ্যপাল তাঁর বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, নির্ধারিত দিনে বিধায়কদের জন্য রাজভবনে অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। তাঁরা না আসায় দুপুরের বিমানে বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যান। বৃহস্পতিবার ডেপুটি স্পিকারকে দায়িত্ব দিয়ে নবনির্বাচিত দুই বিধায়ককে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি।