বছর চোদ্দোর এক কিশোরী আর তার সঙ্গে এক মাঝবয়সি মহিলার কথোপকথন। শুনে বোঝা যাচ্ছিল, কথা হচ্ছে মেয়েটির বিয়ে নিয়ে। দিল্লিগামী দুরন্ত এক্সপ্রেসের কামরায় সহযাত্রীদের তখনই খটকা লেগেছিল।
একে তো নাবালিকার বিয়ে দেওয়াই আইনবিরুদ্ধ। তার উপরে কথাবার্তা শুনে সন্দেহ আরও বাড়ছিল, মেয়েটিকে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে না তো? ট্রেন থেকেই চাইল্ডলাইনকে ফোন করলেন দুই সহযাত্রী, আরএসপি-র মহিলা সংগঠনের নেত্রী সর্বাণী ভট্টাচার্য ও সুচেতা বিশ্বাস। দিল্লি স্টেশনে পৌঁছনোর পরে মেয়েটিকে হেফাজতে নিলেন চাইল্ডলাইনের কর্তারা। হেফাজতে নেওয়া হল সঙ্গের মহিলাকেও। তত ক্ষণে জানা গিয়েছে, মহিলা মেয়েটিরই মা।
ঘটনাটি শুক্রবারের। দিল্লিতে সংগঠনের সম্মেলনে যোগ দিতে তার আগের দিন শিয়ালদহ থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেসে উঠেছিলেন সর্বাণীরা। তাঁদের কামরাতেই মেয়েকে নিয়ে ওঠেন বছর পঁয়ত্রিশের ওই মহিলা। সঙ্গে ছিল এক কিশোরও, যাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেন তিনি। সর্বাণীদেবী জানান, ট্রেন ছাড়ার পরেই তিন জনের মধ্যে বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। সর্বাণী দীর্ঘদিন রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য ছিলেন। শিশুপাচার চক্রের কাজকর্মের সঙ্গে ভাল রকম পরিচিত তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার অভ্যস্ত চোখে ওদের দেখে আর কথা শুনেই সন্দেহ হয়েছিল।’’
কী রকম? মহিলা এবং তাঁর মেয়ের বেশভূষা দেখে বাতানুকূল ট্রেনে ভ্রমণ করার মতো সামর্থ্য তাঁদের আছে বলে মনে হচ্ছিল না। ট্রেন ছাড়ার আগে মহিলা নিজেই সর্বাণীকে নিজের মোবাইলটি এগিয়ে দিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সর্বাণীকে একটি পুরুষ কণ্ঠ প্রশ্ন করে, এটা দুরন্ত এক্সপ্রেস তো? উত্তর পেয়ে নিশ্চিন্ত হয় সে। তার পর থেকে মহিলা সারা ক্ষণ মোবাইলে মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে থাকেন। সে সব কথার ধরনধারনও বেশ সন্দেহজনক বলেই মনে হয়েছিল সর্বাণীদের। গোটা রাস্তা সর্বক্ষণ মোবাইলে ফোন আসা, ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেলে বারবার ও-পার থেকে রিচার্জ করে দেওয়া— চলছিল ক্রমাগত। সর্বাণী তখন সরাসরি ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান।
মহিলা সর্বাণীদের জানান, তিনি মেয়ের মা। কাটোয়ায় বাড়ি। স্বামী মাতাল, সংসার দেখেন না। খরচ টানতে না পেরে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। পাত্রের খোঁজ দিয়েছেন কাটোয়ারই এক পড়শি মহিলা। পাত্র দিল্লিতে ‘এসি গাড়ি’ চালায়। সে-ই ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছে। ট্রেনের টিকিটও কেটে দিয়েছে। ওঁদের প্রথমে বর্ধমান থেকে অন্য একটি ট্রেনে ওঠার কথা ছিল। মহিলার দাবি, ট্রেন ‘মিস’ করায় হবু জামাই-ই ‘নয় হাজার’ টাকা দিয়ে দুরন্তর টিকিট কেটে দিয়েছে। তাকে অবশ্য মহিলা বা তাঁর মেয়ে এখনও অবধি সামনাসামনি দেখেননি কোনও দিন।
সন্দেহ বাড়তে থাকায় সর্বাণীরা প্রথমে মেয়েটিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এই বয়সে বিয়ে করা উচিত নয়। কিন্তু মেয়েটি সে কথা শোনেনি। তখন ট্রেনেই রেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন তাঁরা। জানা যায়, আরপিএফ জওয়ানেরা ধানবাদে নেমে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে মা-মেয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ওঁরা হয়তো কানপুরেও নেমে যেতে পারেন। সর্বাণীরা তখন কানপুর চাইল্ডলাইনে ফোন করেন। কানপুরে ট্রেন থামতে চাইল্ডলাইন কর্তারা এসে মা-মেয়ের কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। দেখা যায়, মহিলা সত্যিই মেয়ের মা। সঙ্গের আধার কার্ডও জাল নয়। তখন দিল্লি পর্যন্ত অপেক্ষা করাই সাব্যস্ত হয়। সর্বাণী রবিবার দিল্লি থেকে ফোনে বলছিলেন, সে রাতে ট্রেনে শুয়ে শুয়ে তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন, মহিলা ফোনে কাউকে জানাচ্ছেন তাঁদের ‘হয়রানি’র কথা। সর্বাণীদের চেহারা আর জামাকাপড়ের বর্ণনা জানানো হচ্ছে ফোনের ও-পারে।
দিল্লি আসতেই ট্রেনের কামরার বাইরে অপেক্ষা করছিল দিল্লি চাইল্ডলাইন এবং রেল পুলিশ। মা-মেয়ে নামতেই দেখা যায় মাঝবয়সী একটি লোক সঙ্গে আরও দু’তিন জনকে নিয়ে তাদের নিতে এসেছে। স্বপ্নের রাজপুত্রের বদলে বাবার বয়সি পাত্র দেখে কিশোরী এ বার বেঁকে বসে। বিয়ে করতে নারাজ সে। অভিযোগ, পাত্র তখন নিজেই এগিয়ে এসে শাসাতে থাকে সর্বাণীকে। তখনই আসরে নামে পুলিশ। জানা যায়, পাত্রের নাম মঙ্গল অধিকারী। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনায়। সবার প্রথমে মা ও তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে হেফাজতে নেয় চাইল্ডলাইন। ময়ূরবিহারে দু’টি হোমে রাখা হয় তাদের।
শুক্রবারই শিশুকল্যাণ কমিটির কাছে মা-মেয়েকে হাজির করে চাইল্ডলাইন। কমিটির সদস্য অংশু ত্যাগী বলেন, “মেয়েটি আমাদের জানিয়েছে, বিয়ে করার জন্য মা তাকে চাপ দিতেন। এমনকী মারধরও করতেন। আমাদের ধারণা, এর সঙ্গে একটি বড় চক্র জড়িয়ে আছে।” একই সন্দেহ চাইল্ডলাইনেরও। সংস্থার তরফে বিনোদ খান বলেন, “আমরা জেনেছি, ওই পরিবারটি বিপিএল তালিকাভুক্ত। অথচ ন’হাজার টাকা খরচ করে বাতানুকূল ট্রেনে দিল্লি এসেছেন তাঁরা।’’ মহিলার কাছে মঙ্গলের একটি ছবি ও আধার কার্ডের প্রতিলিপি মিলেছে। সেটি আসল কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গল আর তার সঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। শিশুকল্যাণ কমিটি পুরো বিষয়টি বঙ্গভবনে বাংলার কমিশনারকেও জানিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে মেয়েদের পাচার করে দেওয়াটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। পাচার-চক্রের সদস্যেরা কখনও বিয়ে, কখনও রোজগারের টোপ দিয়ে নানা কৌশলে গরিব পরিবারের মেয়েদের ফুসলিয়ে পাচার করে দেয়। কখনও কখনও অপহরণও করা হয় কিশোরী-তরুণীদের। মগরাহাটের আয়েশার উপরে নির্যাতনের যে ঘটনায় সম্প্রতি শিউরে উঠেছে গোটা দেশ, সেই মেয়েটিও হঠাৎ এক দিন গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। পরে তাকে গাজিয়াবাদে বিক্রি করে দিয়েছিল পাচারকারীরা।
রবিবার কাটোয়ার কাছেই মেয়েটির গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তাদের টিনের চাল ও ইটের ভাঙাচোরা বাড়ি। সামনে ঝুলছে ত্রিপল। পড়শিরা জানান, দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাড়ির কর্তা দিনভর নেশা করে পড়ে থাকেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই অশান্তি হয়। সপ্তাহখানেক আগে মেজ মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ছাড়েন মহিলা। কোথায় যাচ্ছেন, কাউকে জানাননি।