সময়ের বাঁকে বাঁকে চাপা পড়ে থাকে ইতিহাসের নানা টুকরো। বয়ে যাওয়া সময়ের ঝাঁপি খুলে বসলে বর্তমানের স্রোতে যে প্রবল আলোড়ন পড়তে পারে, বিশেষত রাজনীতিতে, তার নমুনা মিলল আবার!
পঞ্চাশ বছরেরও আগে ঘটে যাওয়া বর্ধমানের সাঁইবাড়ি এবং তার সংলগ্ন এলাকার ঘটনার ‘ভূত’ ফিরে এসে অস্থির করে তুলল রাজ্যে সিপিএম ও কংগ্রেসের সম্পর্ক! কে ঘাতক, কে-ই বা অত্যাচারিত, সেই পুরনো তর্ক পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিল সিপিএম ও কংগ্রেস শিবিরকে, সদ্য বিধানসভা ভোট যে দু’পক্ষকেই শূন্য হাতে ফিরিয়েছে। অতীতের বিরোধ সরিয়ে রেখেই জোট গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দু’দল, জোট ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তও এখনও কেউ নেয়নি। তাই অতীত খুঁড়ে বেদনা জাগানোর এই প্রয়াসে এখানেই ইতি টানতে সচেষ্ট হয়েছেন দু’পক্ষের নেতৃত্ব।
অতীত-চর্চার সূত্রপাত সিপিএমের যুব নেত্রী ও নন্দীগ্রামে বিগত নির্বাচনের প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের সামাজিক মাধ্যমে একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। বর্ধমানের আহ্লাদীপুরে ‘গণহত্যা’র স্মরণে শহিদ দিবস প্রতি বছরই পালন করে সিপিএম। সেই কর্মসূচির কথা জানাতে গিয়ে ‘কংগ্রেসের ঘাতক বাহিনী’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন মীনাক্ষী। সামাজিক মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণে নেমে পড়েন কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের একাংশ। এর পরে প্রকাশ্যে আসে সিপিএমের আইনজীবী-সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যের শেয়ার করা একটি পোস্ট। যেখানে ১৯৭০ সালে বর্ধমানে গোটা ঘটনাবলির বিবরণ আছে, ‘কংগ্রেসের গুন্ডা’ বাহিনীর কথা আছে এবং মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার পরে পরেই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সরকার ক্ষমতায় এসে তারাপদ মুখোপাধ্যায় কমিশন গড়েছিল। সেই কমিশন যখন সাক্ষ্যগ্রহণ করে, তখন কমিউনিস্ট নেতারা জেলে। তদ্সত্ত্বেও সেই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সিপিএম নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করাও হয়নি। যা প্রচলিত আছে, তার আড়ালে ‘আসল ঘটনার কথা’ জানিয়ে এ বারের স্মরণসভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ওই পোস্টে।
এর জেরেই ফুঁসে ওঠেন কংগ্রেস নেতারা। সরাসরি একের পর এক নেতা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, ‘কংগ্রেসের গুন্ডা’দের সমর্থন নিয়েই বিকাশবাবু রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন। তা হলে কি তিনি ইস্তফা দেবেন? সিপিএম যদি এটাই মনে করে, তা হলে জোটই বা কেন?
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা শুভঙ্কর সরকারের কথায়, ‘‘কংগ্রেসের ভোটে সিপিএম সাংসদ পেয়েছে। আবার সিপিএমের ভোটে আমরাও গত বার বিধানসভায় আসন পেয়েছি, বিরোধী দলনেতার পদ পেয়েছি। এই সময়ে যদি পুরনো কথা টেনে আনা হয়, তা হলে বিজেপি এবং তৃণমূল, যারা আমাদের শূন্য দেখতে চায়, তাদেরই সুবিধা হয়।’’ প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান বা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতও একই। তাঁরাও মনে করেন, অতীতের যে বিরোধ সরিয়ে বর্তমানের অভিন্ন লক্ষ্যে জোট হয়েছিল, অতীতকে টেনে আনলে সেই উদ্দেশ্যকেই অর্থহীন করে তোলা হয়।
প্রবল অস্বস্তি সিপিএমের অন্দরেও। মীনাক্ষী ও বিকাশবাবু দলের রাজ্য কমিটির সদস্য। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, ‘‘আমরা বর্ধমান বা কাশীপুর বললে কংগ্রেসও কান্দুয়া বা আরও নানা ঘটনা তুলতে পারে। স্থানীয় ভাবে যে স্মরণ অনুষ্ঠান হয়, তাকে টেনে আমাদের বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়।’’ জলঘোলার খবর পেয়ে বিকাশবাবুও পরে বলেছেন, তিনি কংগ্রেসের সমর্থনে সাংসদ হয়েছেন, এটা সত্য। আবার তার জন্য অতীতও অসত্য হয়ে যায় না! তবে ওই পোস্টের কারণে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা দুঃখ পেয়ে থাকলে তিনি ‘দুঃখিত’। তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের যে নেতারা যোগাযোগ করেছেন, তাঁদেরও বিকাশবাবু বলেছেন বর্তমানকে কোনও ভাবে প্রভাবিত করতে চাননি। প্রসঙ্গত, তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় এসে সাঁইবাড়ি নিয়ে ফের কমিশন গড়েছিল, তার রিপোর্টও এখনও অবধি প্রকাশ্যেও আসেনি।
বিতর্কের প্রেক্ষিতে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, ‘‘সামাজিক মাধ্যমে কে কী পোস্ট করেছেন, এখনও জানি না। দল এই বিতর্কে জড়াতে চায় না।’’ এই বিতর্কের সময় এবং প্রয়োজন এখন যে নেই, বুঝিয়ে দিয়েছেন সূর্যবাবু।
শূন্য ঘরে বোতলের ভূতকে এখন বেরোতে দিয়ে ঘাড়ে চাপতে দেওয়ার পক্ষপাতী নয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।