কোমরে জোড়া রিভলভার গুঁজে রাজ-পাহারায় রক্ষী

হোক না মুকুটহীন, তবু রাজা তো! রাজ-দরবার বা সাতমহলা প্রাসাদ নেই। কিন্তু ‘সেনা বাহিনী’ রয়েছে। দেহরক্ষী, পারিষদ, মোসাহেব রয়েছে। মজুত গোয়েন্দা-বাহিনীও! আর সকলেই বেশ বিত্তবান! জা দত্তকে ছোঁয়ার আগে তাই পেরোতে হবে অনেক দরজা।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য ও সুপ্রকাশ মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০৪:৫৪
Share:

এ ভাবেই বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

হোক না মুকুটহীন, তবু রাজা তো!

Advertisement

রাজ-দরবার বা সাতমহলা প্রাসাদ নেই। কিন্তু ‘সেনা বাহিনী’ রয়েছে। দেহরক্ষী, পারিষদ, মোসাহেব রয়েছে। মজুত গোয়েন্দা-বাহিনীও! আর সকলেই বেশ বিত্তবান!

রাজা দত্তকে ছোঁয়ার আগে তাই পেরোতে হবে অনেক দরজা। হালিশহরে সে সাধ্য কারও নেই বলেই জানেন বাসিন্দারা। কারণ, রাজার ‘নেটওয়ার্ক’। যার মাধ্যমে রাস্তার ধারে সামান্য চায়ের দোকান হলেও খবর আসে তার কাছে।

Advertisement

কেমন সে ‘নেটওয়ার্ক’?

এই রাজ-কাহিনির অন্যতম চরিত্র পাসি। হালিশহরের ভাইস-চেয়ারম্যান রাজা দত্তের দেহরক্ষী। পরনে সদাই লুঙ্গি-ফতুয়া। পুলিশের একাংশের দাবি, তার কোমরে সব সময় গোঁজা থাকে দু’টি নাইন এমএম। সন্ধ্যার পর পাসিকে ছাড়া রাজাকে দেখা যায় না। দিনে রাজাকে ঘিরে থাকে অসীম আর রানা।

রাজার এক শাগরেদ জানাচ্ছে, নিখুঁত নিশানায় গুলি চালাতে দড় পাসির বিরুদ্ধে থানায় একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কয়েকবার সে শ্রীঘরেও গিয়েছে। প্রোমোটারদের চমকে টাকা আদায়, শরিকি-বাড়ির বিবদমান মালিকদের নিজের ডেরায় নিয়ে এসে বাড়ি বিক্রির দলিলে সই করাতে পাসির বিকল্প নেই। এই সময়ে সে টেবিলের এক পাশে রাখে রিভলভার। অন্যপাশে বাড়ি-বিক্রির দলিল। সহজেই সেই দলিল সই হয়ে চলে আসে পাসি হাতে।

রাজ-কাহিনির আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আর এক রাজা। নতুন দোকান বসানো থেকে শুরু করে ‘হপ্তা’ আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তার। রাজার দলেরই এক সদস্য জানাচ্ছে, কাঁচরাপাড়া বা হালিশহরে কোথাও নতুন কোনও দোকান হলে রাজকোষে এককালীন টাকা জমা করতে হয়। ব্যস্ত এলাকায় ছোট চা-দোকান বা পান-গুমটির জন্য ৩০ হাজার টাকা। ছোট দোকান হলে ৬০ হাজার এবং মাঝারি হলে দেড় লক্ষ টাকা। আর বড় দোকান হলে ‘রেট’ তিন লক্ষ টাকা। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহে জমা করতে হয় ‘হপ্তা’। মরসুম অনুযায়ী তার ‘রেট’ ওঠানামা করে। কাঁচরাপাড়ার বিখ্যাত বাজার ‘হকার্স কর্নার’-এর এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রতি সপ্তাহে এই বাজার থেকে ৬০ লক্ষেরও বেশি টাকা ‘হপ্তা’ আদায় হয়।

আর রয়েছে রাজার ‘তিনর্মূতি’— পঙ্কা-টঙ্কা-পিকু। পঙ্কা ওরফে পঙ্কজ এবং পিকু রাজ পরিবারেরই সদস্য। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পঙ্কার কাজ সারা শহরের খবর জোগাড় করা। কোথায় কোন বাড়ির সামনে ইট-বালি পড়ছে, কোন বাড়ি বিক্রি হবে, কোন বাড়ির শরিকি-বিবাদ চরম। ফলে, সেই বাড়ি কম দামে পাওয়া যাবে। ‘ইভটিজার’ হিসেবেও পঙ্কা যথেষ্ট 'সুনাম' অর্জন করেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী জানিয়েছেন, পঙ্কার জ্বালায় তাঁদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তার জন্য কয়েক দিন পর পর রাস্তা বদল করতে হয় তাদের। টঙ্কার কাজ বেনামে রাজার ঠিকাদারি—ব্যবসা দেখভাল করা। হালিশহর পুরসভার অন্য ঠিকাদারদের বিল এক রকম জোর করে ‘পাশ’ করিয়ে তাদের থেকে তোলা আদায়ের দায়িত্ব তার।

এই দলে বছর দুয়েক আগে পিকুর আগমন। অল্পদিনের মধ্যেই সে রাজার আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। রাজার ব্যবসার বেশ কিছুটা দেখভাল করে সে। অল্পদিনের মধ্যেই এই কারবারের টাকায় সে জমি কিনে দোতলা বাড়ি হাঁকিয়ে ফেলেছে।

রাজ-কাহিনির কুশীলব রয়েছে আরও। যাদের অনেকেই হতদরিদ্র অবস্থা থেকে মাত্র দু’তিন বছরেই বিত্তবান হয়েছে রাজার প্রসাদ পেয়ে। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ওদের ঘাঁটাবে কে? রাজার পাশে যে ‘রায়বাহাদুর’ আছেন। তাই কিছুতেই ওরা ডরায় না। এমনকী, তিন বছরের সায়ন্তিকাকে মারতেও হাত কাঁপে না।

সাধারণ মানুষ রাজা ও তার দলবলের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগের কথা মুখে বললেও থানা পর্যন্ত যেতে সাহস করেন না। পুলিশও জানিয়ে দিয়েছে, বীজপুর থানায় রাজার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে, এই ভোট-মরসুমে পুলিশের ‘পরির্বতন’ দেখে কিছুটা আশার আলো চোখে পড়ছে ভুক্তভোগীদের। তাঁরা মনে করছেন, এ বার পুলিশ পুলিশের কাজ করবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement