সরকারি অনুদান নিয়েই জুয়া ক্লাবে

তিন বছর আগে, ২০১৩ সালে রাজ্য সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতর থেকে দু’লাখ টাকার সামগ্রী কিনে দেওয়া হয়েছিল। যাতে তারা আধুনিক জিমন্যাশিয়াম তৈরি করতে পারে। সেই ক্লাবেই জুয়ার আখড়া থেকে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বগুলার সেই জাগরণ ক্লাবের হর্তাকর্তারা তৃণমূলের ছায়ায় লালিত। আর, সেই কারণেই তাদের সরকারি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

বগুলা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৬ ০২:০১
Share:

সেই ক্লাবঘর। — নিজস্ব চিত্র।

তিন বছর আগে, ২০১৩ সালে রাজ্য সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতর থেকে দু’লাখ টাকার সামগ্রী কিনে দেওয়া হয়েছিল। যাতে তারা আধুনিক জিমন্যাশিয়াম তৈরি করতে পারে।

Advertisement

সেই ক্লাবেই জুয়ার আখড়া থেকে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বগুলার সেই জাগরণ ক্লাবের হর্তাকর্তারা তৃণমূলের ছায়ায় লালিত। আর, সেই কারণেই তাদের সরকারি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

Advertisement

আর, বগুলার সেই জাগরণ ক্লাবেই নিয়মিত তাসের জুয়ার আসর বসছিল বলে অভিযোগ। কানাঘুষোয় সেই খবর শুনেই রাতে আচমকা হানা দিয়েছিল পুলিশ। ক্লাবের ভিতর থেকেই বগুলা ২ পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের কমলাবালা বিশ্বাসের স্বামী গৌতম বিশ্বাসকে পাকড়াও করা হয়। যদিও তৃণমূলের লোকজনের বাধায় পুলিশ তাঁকে নিয়ে যেতে পারেনি।

২০১৩ সালে অনুদানের তালিকায় জাগরণ ক্লাবের নাম পাঠিয়েছিলেন রানাঘাট (উত্তর-পূর্ব)-এর তৃণমূল বিধায়ক সমীরকুমার পোদ্দার। জুয়ার আসর বসানোর জন্যই কি সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছিল ক্লাবটিকে? বিধায়কের বক্তব্য, ‘‘ওরা নিয়মিত বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওরা খেলার বাইরে অন্য কোনও কিছু করে, এমন অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি।’’

তা হলে পুলিশ কেন হঠাৎ করে হানা দিল? সমীরবাবুর জলদি জবাব, ‘‘এটাও বুঝতে পারছেন না? সামনে ভোট। বিরোধীরা চক্রান্ত করে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে পু‌লিশকে। পুলিশের আরও খোঁজখবর করা উচিত ছিল।’’ পঞ্চায়েত সদস্যা কমলাবালাও একই সুরে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন। ঠিক যে ভাবে, নারদ-কাণ্ডে নেতাদের ঘুষ নেওয়ার ছবি টিভিতে দেখা যাওয়ার পরে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী এবং তাঁর দেখাদেখি গোটা দল!

কিন্তু পুলিশ যে জাগরণ ক্লাবের ভিতর থেকে প্রায় সাতশো টাকা আর তাসের প্যাকেট উদ্ধার করেছে? বিধায়কের দাবি, ‘‘আমার কাছে খবর আছে, সেখান থেকে ও সব কিছুই পাওয়া যায়নি। ক্লাবে ছেলেরা ক্যারম খেলছিল। এ বার আপনারাই বোঝার চেষ্টা করুন, কী থেকে কী হচ্ছে!’’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালে বগুলা স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় জাগরণ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা। দু’তলা বাড়ি, আছে জিমও। দেখলেই বোঝা যায়, ক্লাবের যথেষ্ট পয়সা আছে। বড় করে দুর্গাপুজোও হয়। কিন্তু পুলিশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, রাত নামতেই ক্লাবের ভিতরে বসে যায় জুয়ার বোর্ড। হাজার হাজার টাকার খেলা হয় প্রতিদিন।

এই খবর পেয়েই সোমবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ এসডিপিও (রানাঘাট) ইন্দ্রজিৎ বসু দু’গাড়ি পুলিশ নিয়ে আচমকা হানা দেন ওই ক্লাবে। পুলিশের দাবি, তিন জনকে হাতেনাতে ধরেও ফেলা হয়। তাঁদের অন্যতম গৌতম বিশ্বাস। কিন্তু পুলিশ তাঁদের গাড়িতে তোলার সময়ে স্থানীয় কিছু মহিলা ও পুরুষ, যাঁদের বেশির ভাগই তৃণমূল সমর্থক, বাধা দেন। জোর করে তিন জনকেই ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। পুলিশ সামাল দিতে গেলে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু হয়। ইটে আহত হন চার পু‌লিশকর্মী। এসডিপিও-র গাড়ি এবং অন্য একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

অন্ধকারে এমন আক্রমণের মুখে পড়ে পিছু হটে পুলিশ চলে যায় হাঁসখালি থানায়। সেখান থেকেই আহত পুলিশকর্মীদের বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বড় বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে যান হাঁসখালি থানার ওসি অনিন্দ্য বসু। গ্রেফতার করা হয় পাঁচ জনকে। গভীর রাত পর্যন্ত জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজয় প্রসাদের নেতৃত্বে বাকি হামলাকারীদের খোঁজে তল্লাশি চলে। ওই সময়ে পুলিশ এক ক্লাবকর্তার বাড়িও ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ।

যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের নাম দিলীপ কর্মকার, বাবলু শীল, গোপাল হাজরা, প্রশান্ত হিরা ও সফিকুল প্রধান। প্রথম তিন জন এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলেই পরিচিত। এ দিন রানাঘাট আদালতে তোলা ধৃতদের জেল হাজতে পাঠিয়ে আজ, বুধবার ফের হাজির করতে বলা হয়েছে। মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে, তার মধ্যে ১৩ জন এখনও অধরা। এঁদের মধ্যে গৌতম বিশ্বাস ছাড়াও বগুলা ১ পঞ্চায়েতের সদস্য ফাল্গুনী ঠাকুর রয়েছেন। তাঁরা পলাতক বলে পুলিশের দাবি।

পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ গৌতম বিশ্বাস ফোনে দাবি করেন, ‘‘ক্লাবে জুয়া খেলার কোনও ব্যাপারই নেই। তা সত্ত্বেও পুলিশ ক্লাবের একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি প্রতিবাদ করলে আমাকেও ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুঝতে পারছি না, পুলিশ হঠাৎ কেন এমন করল!’’ তাঁর স্ত্রী কমলাবালার দাবি, ‘‘পুলিশ মিথ্যা অভিযোগে তিন জনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের মানুষ সেটা মানতে পারেনি। কিছু বাচ্চা ঢিল ছুড়েছিল। তাতেই পুলিশের গাড়ির কাচ ভেঙে থাকতে পারে।’’

সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে-র কটাক্ষ, ‘‘ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়ার পিছনে রাজনীতি ছাড়া কিছু নেই। তা কাজে লাগিয়ে তোলাবাজি থেকে শুরু করে জুয়া, সবটাই চলছে। মানুষ এখন প্রশ্ন তুলছেন, সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য জুয়া খেলাই কি ক্লাবটির প্রধান যোগ্যতা ছিল?’’

শুধু রাজ্য সরকারের অনুদান নয়, জেলা পরিষদের ফুটবল বা ক্যারম বোর্ডের মতো সামগ্রী বিলির ক্ষেত্রেও শাসক দলের আনুগত্যই প্রধান বিচার্য বলে অভিযোগ বিরোধীদের। সম্প্রতি নদিয়া জেলা পরিষদ থেকে শুধু মাত্র তৃণমূল সদস্যদের মাধ্যমে শতাধিক ক্লাবকে সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছিল। এবং বেছে-বেছে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ক্লাবগুলিকেই দান খয়রাতি করা হয় বলে অভিযোগ বিরোধীদের।

সুমিতবাবুর আক্ষেপ, ‘‘একে এই রাজনৈতিক পক্ষপাত। তার উপরে, জুয়া বন্ধ করতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হচ্ছে। রাজ্যের কী দশা, ভাবা যায়!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement