স্বমহিমায়: মঙ্গলবার কলকাতায় ভিকি রায়। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
পুরুলিয়া থেকে বাকিংহাম প্যালেস। শৈশবে দু’বেলা খাবারের অনিশ্চয়তা থেকে তাঁর তোলা ছবির স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কারের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে প্রিন্স এডওয়ার্ডের সঙ্গে ভোজ।
নিউ ইয়র্কের ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ফটোগ্রাফি’তে ছ’মাসের প্রশিক্ষণের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার পুনর্নির্মাণের ছবি তোলার বরাত।
দেশ-বিদেশে তিনশোরও বেশি মঞ্চে ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হিসেবে বক্তৃতা।
কিন্তু ঝাঁ চকচকে জীবনের হাতছানি পেরিয়েও শিকড় না-ভোলা।
বাড়ি থেকে পালিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি পেরনোর এমন সব ‘গল্পে’র বাস্তবচরিত্র পুরুলিয়ার ভিকি রায়। প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়নো বা রেস্তোরাঁয় বাসনমাজার জীবন পেরিয়ে যিনি জীবনের নানা মুহূর্তকে লেন্সবন্দি করে পেশাগত চিত্রগ্রাহক হিসেবে এখন প্রতিষ্ঠিত। মঙ্গলবার বণিকসভা সিআইআইয়ের মঞ্চ থেকে কর্পোরেট দুনিয়া তাঁর জীবনের গল্প শুনল। আর তাঁর সঙ্গে ‘সেলফি’ তুলে অনেকেরই আক্ষেপ, ‘‘ইস্, ওঁর মতো হল না।’’
সাত ভাইবোনের অভাবী সংসারের মেজ সন্তান ভিকির ঠাঁই হয়েছিল দাদু-দিদিমার কাছে। সেখানেও অনটনের জ্বালায় এক দিন ট্রেনে চেপে পুরুলিয়া থেকে সোজা দিল্লি। সেই প্রথম অত বড় স্টেশন দেখা। সেখানেই পাতানো বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ফেলে দেওয়া বোতলে পানীয় জল ভরে বিক্রি। এরপর ধাবায় কাজ। সেখান থেকে মীরা নায়ারের ‘সালাম বম্বে’ দেখে পথশিশুদের জন্য তৈরি ‘সালাম বম্বে ট্রাস্ট’-এর স্কুলে এসে জীবনের নতুন বাঁক়।
মাধ্যমিকে নম্বর তত ভাল না হওয়ায় পেশামুখী পাঠ্যক্রমে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছিল স্কুল। কিন্তু ভিকি চেয়েছিলেন ছবি তোলা শিখতে। প্রশিক্ষণের সময় ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিক্সি বেঞ্জামিনের সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ আসে। স্কুল ছাড়ার পরে ‘পোট্রেট ফটোগ্রাফার’ আনয় মানের সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজের পাশাপাশি আলাদা কাজও শুরু করেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পথশিশুদের নিয়ে তোলা ছবি প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। সময়ের সঙ্গে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ বাড়তে থাকে। আমন্ত্রণ আসে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বক্তৃতার দেওয়ারও।
আরও পড়ুন: বইমেলার সূচনায় সৌমিত্র-মমতা
এমন গল্পেও অনেক বাঁকে হারিয়ে যায় সাফল্য। কিন্তু ভিকি জানালেন, তাঁকে সমানে দিশা দেখিয়েছেন চিত্রগ্রাহক আনয় মান। ভাল ছবি তুলতে হলে ছবির বই বা প্রদর্শনী দেখার কথা বলতেন তিনিই। একদিন কফিশপে ডেকে ভিকিকে ‘অ্যাটিটিউড’ ঝেড়ে ফেলে মাটির কাছাকাছি থাকার পরামর্শও দিয়েছিলেন আনয়।
বোধহয় সেই সূত্রেই শিকড়কে না ভুলে আরও অনেকের জীবনে রং আনতে ভিকি তৈরি করেন ছবি ও প্রদর্শনীর ‘রং লাইব্রেরি’। পালানোর পাঁচ বছর পরে বাড়ি ফিরে কাঁধে তুলে নেন পরিবারের দায়িত্বও। ‘মাদার্স ডে’তে পুরুলিয়ায় বাড়ি তৈরি করে মায়ের হাতে তুলে দেন তিনি।
তা হলে বাকিদের জন্য তাঁর বার্তা কী? অনেকটা ‘থ্রি ইডিয়টসে’র র্যাঞ্চোর ঢঙে ভিকি বললেন, ‘‘কোনও আশা না রেখে সততার সঙ্গে কাজ করুন। যোগ্য হোন। যা পাওয়ার তা ঠিক মিলবেই।’’