ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি মাথায় মাঠে দাপিয়ে বে়ড়াচ্ছিল ছেলের দল। ছাতা, প্লাস্টিক মাথায় কিংবা আদুর গায়ে খেলা দেখতেও মন্দ ভিড় জমেনি। তবে আকাশের ভাবসাব দেখে কেউ কেউ বলেছিল, খেলা বন্ধ করে বাড়ি ফিরলেই ভাল। কিন্তু সে সব কথা কানে তোলেনি দস্যি ছেলেরা। প্রাণ দিয়ে যার মাসুল গুণতে হল চার জনকে।
রবিবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটেছে সন্দেশখালির দক্ষিণ আখড়াতলায়। বাজ পড়ে এখানে মারা গিয়েছে মিঠুন মুন্ডা (১৭), শুভজিৎ সর্দার (১৭), অমিত সর্দার (১৬) এবং নারায়ণ সর্দার (১৪)। সকলেরই বাড়ি ওই এলাকার অর্জুন সর্দারপাড়ায়। জখম আরও এগারো জন। তাদের আনা হয়েছে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে। মৃতদের দেহ ময়না-তদন্তে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকাল থেকেই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলছিল আকাশ জুড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ কালো করে জোর বৃষ্টি নামে। দেখে বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে অর্জুন সর্দারপাড়ার কয়েক জন। একটি ইটভাটা-সংলগ্ন মাঠে শুরু হয় বল নিয়ে দাপাদাপি। খেলা দেখতে ভিড়ও জমে যায়।
বেশ খানিকক্ষণ খেলার পরেও কোনও পক্ষ তখনও কোনও গোল করতে পারেনি। এ দিকে প্লেয়াররা সকলে কাদায় মাখামাখি। ধুপধাপ গড়াগড়ি খাচ্ছে মাঠে। যা দেখে তুমুল হাততালি উঠছে দর্শকদের মধ্যে। সব মিলিয়ে টানটান পরিবেশ।
ছন্দটা কাটল বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ। হঠাৎই আকাশে প্রবল আলোর ঝলকানি। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কানফাটা আওয়াজ। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে যখন সকলে চোখ মেলে তাকাল, দেখা গেল মাঠের মধ্যে পড়ে আছে কাদামাখা আট জন খেলোয়াড়। কেউ তখনও ছটফট করছে। বাকিরা ততক্ষণে নিথর।
শুরু হয়ে যায় চিৎকার, হইচই, আর্তনাদ। ছুটে আসে স্থানীয় একটি ক্লাবের ছেলেরা। তারাই সকলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চার জনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। সুকুমার মুন্ডা, শিবু মুন্ডা, ছোটন দাস এবং প্রসেন দাস, সৌরভ মণ্ডল, সত্যজিৎ পাত্র, বিশ্বজিৎ পাত্র, আলমগির গাজি, সুমিত সর্দার, অমিত সর্দার, সম্রাট সর্দারকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ দিন বসিরহাট জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের চার চারটি তরতাজা প্রাণ হঠাৎ চলে যাওয়ায় কান্নার রোল উঠেছে। গ্রামের শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় করেছেন হাসপাতালে। একই সঙ্গে শোক আর আতঙ্কেরও পরিবেশ।
জ্ঞান ফিরেছিল পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সুকুমারের। তার কথায়, ‘‘খুব বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু আমরা খেলা থামাইনি। হঠাৎ আলোর ঝলকানি, শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে গেল। বল নিয়ে একটি জটলা চলছিল মাঝমাঠে। আমি ছিলাম একটু দূরে। চোখ মেলতেই দেখি, মাঠে সকলে শুয়ে আছে। আমার শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। পা কাঁপছিল। শুয়ে পড়লাম। খানিকক্ষণ পরে চোখ খুলে দেখি, আশপাশে কেউ নড়ছে না। দূর থেকে লোকজনের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি উঠে ছুটতে শুরু করলাম। দু’চার পা গিয়েই পড়ে গেলাম। তারপরে আর কিছু মনে নেই।’’
গ্রামের বাসিন্দা শম্ভু সর্দার, প্রসেনজিত সর্দার, ইলিয়াস গাজিরা বলেন, ‘‘যারা মারা গিয়েছে, যারা আহত, সকলেই খুব গরিব আদিবাসী পরিবারের।’’