মুক্ত চিন্তায় মার, আক্ষেপ শিক্ষক মনমোহনের গলায়

ক্ষমতার রাজনীতিতে বরাবরই তাঁর নিজেকে বেমানান লাগে। নইলে কি আর আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম হয় ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’? রাজনীতিতে এসে পড়া যে নেহাতই পাকেচক্রে, তার চেয়ে ক্লাসরুমেই তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন ঢের বেশি— এই আক্ষেপ বেরিয়ে আসে সামান্য সুযোগেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:৪৫
Share:

ক্ষমতার রাজনীতিতে বরাবরই তাঁর নিজেকে বেমানান লাগে। নইলে কি আর আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম হয় ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’? রাজনীতিতে এসে পড়া যে নেহাতই পাকেচক্রে, তার চেয়ে ক্লাসরুমেই তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন ঢের বেশি— এই আক্ষেপ বেরিয়ে আসে সামান্য সুযোগেই। প্রেসিডেন্সি কলেজ শুক্রবার আক্ষেপ-সমেত কাছে পেল সেই মনমোহন সিংহকে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও যিনি অনেক বেশি শিক্ষক এবং সেই সত্তা থেকেই যিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্ত চিন্তার উপরে রাজনীতি ও অন্য সব ধরনের ছড়ি ঘোরানোয় বেদনাহত।

Advertisement

প্রেসিডেন্সি কলেজের দু’শো তম প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে এ দিন কলেজ স্ট্রিটের ক্যাম্পাসে মনমোহন ছিলেন একেবারেই শিক্ষকের মেজাজে। নিজের পরিবারে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন। দাদু ছিলেন নিরক্ষর। বাবা ক্লাস এইট পাশ। সেই পরিবার থেকে এসে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডে বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতির চর্চা করে আসা গবেষককে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সামিল করে দিয়েছিলেন নরসিংহ রাও। ভারতে উদারনীতির হাওয়ার প্রবেশ যে অর্থমন্ত্রী মনমোহনের হাত ধরে, তিনি যে নিজেকে রাজনীতিবিদ ভাবতে মোটেও ভালবাসেন না, তার ইঙ্গিত অজস্র বার ধরা পড়ল প্রেসিডেন্সির প্রেক্ষাগৃহে। মনমোহন সরাসরিই বললেন, ‘‘রাজনীতিতে আমি ঢুকে পড়েছিলাম ঘটনাচক্রে! আমি সব সময়েই শিক্ষক হতে চেয়েছি। আমার লক্ষ্যই ছিল, শিক্ষক হয়ে পড়ানো। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কোনও সুযোগ এলে হাতছা়ড়া করতে চাই না।’’

শিক্ষকের মনোবৃত্তি নিয়েই পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নিয়ে এ দিন দুঃখ করেছেন মনমোহন। বলেছেন, ‘‘স্বাধীন চিন্তা এবং বাধাহীন ভাবে কাজ করতে পারা এখন আটকে যাচ্ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে। নানা নিয়োগ হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে। হায়দরাবাদ বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটনা ঘটেছে, একেবারেই অগণতান্ত্রিক। শিক্ষার পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর।’’ অর্থনীতির কৃতবিদ্য শিক্ষকের আরও যুক্তি, পড়ুয়াদের স্বাধীন চিন্তায় উৎসাহ দেওয়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ। যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা মগজ ধোলাইয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে চালানো প্রচার অস্বীকার করতে পারে, কল্পনা থেকে বাস্তবকে আলাদা করতে শেখে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে সব সময়েই দাঁড়াতে হবে মানবতা ও সহিষ্ণুতার পক্ষে। সাম্প্রদায়িকতা, অস্পৃশ্যতা বা জাতপাতের মতো বিষয়ের জায়গা সেখানে থাকবে না।

Advertisement

সরাসরি কোনও নাম না করলেও হায়দরাবাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার মতো ঘটনা যে মেনে নেওয়া যায় না, বোঝা গিয়েছে মনমোহনের বক্তব্যে। সঙ্ঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে নানা প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসিয়ে দেওয়ার প্রবণতার সমালোচনাও বোঝা গিয়েছে। আর কথাগুলো যে হেতু কলকাতায় দাঁড়িয়ে বলা, তাই শিক্ষা মহলের অনেকেরই মনে হয়েছে, এ রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে চলা একের পর এক তাণ্ডবের নিন্দাও নিজস্ব মিতবাক কায়দায় সেরে রাখলেন মনমোহন।

শিক্ষক আর রাজনীতিকের সত্তা মিশে গেল এক বারই, যখন প্রেসিডেন্সির সূত্র ধরেই বাংলার নানা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কথা বললেন মনমোহন। তাঁর কথায়, ‘‘অমর্ত্য সেনকে চিনি। দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগতো। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গেও অনেক আলোচনা হয়েছে। সংসদে অনেক কিছু শিখেছি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। অর্থনীতির হালচাল নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে অসীম দাশগুপ্তের সঙ্গে। আর অমিত মিত্র দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে আমার কাছে পড়েছেন।’’

ওই পর্যন্তই। প্রেসিডেন্সির সেরা প্রাক্তনী হিসাবে এ বারের পুরস্কার যখন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর হাতে তুলে দিচ্ছেন, সস্ত্রীক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে অভর্থ্যনা জানাতে দাঁড়িয়ে পড়েছে গোটা ডিরোজিও হল— মনমোহন সিংহ তখন আপাদমস্তক শিক্ষক! যিনি ক্লাসরুমটা ‘মিস’ করেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement