ভারতী সরলেও বিঁধছে কাঁটা

তিনি ভারতী ঘোষ, বরাবর বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের সদ্য প্রাক্তন পুলিশ সুপার। মঙ্গলবার পুলিশ সুপারের পদ থেকে অব্যাহতি নিলেন তিনি। নতুন পুলিশ সুপার হয়েছেন ভাদনা বরুণচন্দ্র শেখর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৪
Share:

নতুন ও পুরনো। সামনে ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখর, পিছনে ভারতী ঘোষ। মঙ্গলবার।— সৌমেশ্বর মণ্ডল

তিনি সরলেন, আবার সরলেন না-ও!

Advertisement

তিনি ভারতী ঘোষ, বরাবর বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের সদ্য প্রাক্তন পুলিশ সুপার। মঙ্গলবার পুলিশ সুপারের পদ থেকে অব্যাহতি নিলেন তিনি। নতুন পুলিশ সুপার হয়েছেন ভাদনা বরুণচন্দ্র শেখর। তিনি এক সময় খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্ব সামলেছেন। ভারতীদেবীর নয়া দায়িত্ব মাওবাদী মোকাবিলার। মাওবাদী দমনে নিযুক্ত বিশেষ বাহিনীর প্রধান করা হয়েছে (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, এলডব্লিউই অপারেশনস্) তাঁকে। এই বিভাগের সদর দফতর বাঁকুড়ায়। তবে পশ্চিম মেদিনীপুরের ২৯টি ব্লকের মধ্যে ১১টিই মাওবাদী প্রভাবিত (এলডব্লুই)। এর মধ্যে ঝাড়গ্রামের ৮টি, মেদিনীপুরের (সদর) ৩টি ব্লক রয়েছে। অর্থাৎ, জঙ্গলমহলের একটা বড় অংশেই ভারতীদেবীর প্রভাব থেকে গেল। বিরোধীদের একটা অংশও তাই বলছেন, সরেও সরলেন না ভারতীদেবী!

এ দিন ভারতীদেবীর মন্তব্য, “আমি সব সমালোচনা উপভোগই করি!” সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “থাক না আজ এ সব কথা!” পুলিশেরই এক সূত্রে খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে এ দিন ভারতীদেবী বলেছেন, “পুলিশ সুপারের পদে থেকে যে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে সেই কাজই করেছি। কেউ আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন শুনলে খারাপই লেগেছে। তবে আমি কখনও ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি। মনে আঘাত করে, কাউকে এমন কোনও কথা বলিনি।”

Advertisement

বিরোধীদের ওই অংশ আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভারতীদেবী পুলিশ সুপারের পদ থেকে সরলেও পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর ‘অনুগামী’ পুলিশ আধিকারিকের সংখ্যা কম নয়। তা ছাড়া, এতদিন সিনিয়র আইপিএস পুলিশ অফিসাররা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার হলেও ইএফআরের প্রথম ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখর ভারতীদেবীর থেকে জুনিয়র ব্যাচের অফিসার। তার উপর ভারতীদেবী শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন না, একই সঙ্গে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্বও সামলেছেন। ফলে, জঙ্গলমহলের আতিপাতি তার জানা। ফলে, সার্বিক ভাবে মাওবাদী মোকাবিলার দায়িত্ব পাওয়ায় ভারতীদেবী সহজেই জেলায় প্রভাব ধরে রাখতে পারবেন বলে পুলিশেরই একাংশ মনে করছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “পশ্চিম মেদিনীপুরের একটা বড় অংশ জঙ্গলমহল। উনি (ভারতী ঘোষ) জঙ্গলমহলেই মাওবাদী মোকাবিলার দায়িত্ব পেয়েছেন। ফলে, জেলায় ওঁর প্রভাব তো থাকবেই!”

তবে বিধানসভা নির্বাচনের মুখে ভারতীদেবী বদলি হওয়ায় কি ভোটটা নির্বিঘ্নে হওয়ার আশা করছেন বিরোধীরা? সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের বক্তব্য, “আগে নতুন পুলিশ সুপারের কাজ দেখতে হবে। তারপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে। তবে আশা করব, নতুন পুলিশ সুপার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে, শুধুমাত্র শাসক দলের কথা না শুনে কাজ করবেন। বিগত দিনে যে সব অন্যায় ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিকারও করবেন!” জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়াও বলছেন, “আশা করব, নতুন পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের মতো হবেন না। নির্বাচন কমিশনকে মান্যতা দেবেন। বিরোধী দলের কথাও শুনবেন।” আর বিজেপির জেলা সভাপতি ধীমান কোলের মতে, “পুলিশের নিরপেক্ষই থাকা উচিত। দুর্ভাগ্য, আগের পুলিশ সুপার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি। আশা করব, নতুন পুলিশ সুপার নির্দিষ্ট কোনও দলের স্বার্থ না দেখে কাজ করবেন।” তাঁর সংযোজন, “ভারতী ঘোষ মাওবাদী মোকাবিলার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে শুনছি। আমরা সব দিকেই নজর রাখছি!”

পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার থাকাকালীন বিতর্ক কখনও ভারতীদেবীর পিছু ছাড়েনি। কখনও প্রকাশ্য মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলে সম্বোধন করেছেন, কখনও পিংলার ব্রাহ্মণবাড় গ্রামে বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রীর দাবির পুনরাবৃত্তি করে জানিয়েছেন, ‘বাজি কারখানায় বিয়ে বাড়ির জন্য বাজি তৈরি হচ্ছিল।’ অথচ এলাকাবাসীর দাবি ছিল, শাসক দলের মদতেই সেখানে বোমা তৈরি হয়। সবং কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানার খুনের ঘটনাতেও মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মেলান ভারতীদেবী। জানিয়ে দেন, ছাত্র পরিষদের কোন্দলেই এই ঘটনা। চার্জশিটেও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর ধৃতদের লঘু ধারা দেওয়া হয়। তখন কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, শাসক শিবিরকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন পুলিশ সুপার। খড়্গপুরে পুর-নির্বাচন পর্বেও মাফিয়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধীদের হেনস্থার অভিযোগ ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। সে ক্ষেত্রেও ভারতীদেবীই ‘মাস্টার মাইন্ড’ ছিলেন বলে সরব হয়েছিল বাম-বিজেপি-কংগ্রেস।

এই সব ঘটনাক্রম সামনে রেখে বিরোধীদের কেউ কেউ ভারতীদেবীকে বলতেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাসম’, কারও আবার কটাক্ষ ছিল, ‘আসলে উনি পুলিশ সুপার নন, জেলা তৃণমূলের সভানেত্রী।’ ফলে, ভারতী ঘোষের বিদায়েও খুব একটা স্বস্তিতে নেই বিরোধী শিবির। উল্টে তাঁদের আশঙ্কা, মাওবাদী মোকাবিলার বৃহত্তর দায়িত্ব দিয়ে আসলে ভারতীদেবীর কাজের পরিধি বাড়িয়ে দিলেন মমতা। গোটা জঙ্গলমহলের সব আসনে তৃণমূলের জয় নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ। বিরোধীদের এই সব বক্তব্যে অবশ্য আমল দিচ্ছে না তৃণমূল। দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের দাবি, “পুলিশ তো নিরপেক্ষ ভাবেই কাজ করে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement