‘এটা করবো সেটা করবো’ বা ‘ওরা যা পারেনি, সব করে দেখাবো’র গর্জন সব দলেরই নির্বাচনী ইস্তাহারে। এবং দেওয়ালের লিখন জুড়েও।
কিন্তু ‘জলাভূমি বাঁচাচ্ছি, বাঁচাবো’ কিংবা ‘বাযুদূষণ রুখবো’ বা ‘শব্দদূষণ রুখছি রুখবো’ ‘গঙ্গায় বর্জ্য ফেলা ঠেকাবোই ঠেকাবো’ জাতীয় স্লোগান দলীয় ইস্তাহারে বা কলকাতা ঢুঁড়েও কোনও দলের ভোটের দেওয়াল-লিখনে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
নির্বাচনী মহোৎসবে পরিবেশ এমনই ব্রাত্য! তাকে দূরে রাখার বা ভুলে থাকার ব্যাপারে শাসক-বিরোধীর সুরে বিশেষ তফাত নেই!
শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে পরিবেশ নিয়ে আলাদা কোনও পরিচ্ছেদ নেই। গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, পর্যটনের মতো বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে দু’-এক লাইন পরিবেশ এসে পড়েছে মাত্র। বামফ্রন্ট তাদের ইস্তাহারে পরিবেশ নিয়ে আলাদা পরিচ্ছেদ রাখলেও ভঙ্গিটা ভিক্ষে দেওয়ার মতো। সাকুল্যে বরাদ্দ সাড়ে পাঁচ লাইন! যা দেখে পরিবেশকর্মীদের যৌথ সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর আহ্বায়ক নব দত্তের মন্তব্য, ‘‘আসলে পরিবেশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির বলার মতো কিছুই নেই।’’
ভোটের লড়াইয়ে পরিবেশের গুরুত্ব কতটা, তা নিয়ে রবিবার আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল পরিবেশকর্মীদের যৌথ সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’। সেখানে বাম ও কংগ্রেস নেতারা হাজির হলেও ছিলেন না তৃণমূল, বিজেপির কোনও প্রতিনিধি। সেই অনুষ্ঠানে আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য এবং কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র মেনে নিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পরিবেশ এখনও গুরুত্ব পায় না। ‘‘দলগুলিতে এমন পদাধিকারী নেই, যিনি পরিবেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ,’’ বলছেন ওমপ্রকাশবাবু। আর মনোজবাবুর প্রশ্ন, দূষিত কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে, এ কথা কোনও রাজনৈতিক দল সাহস করে বলতে পারবে কি? পরিবেশ নিয়ে সাড়ে পাঁচ লাইন বরাদ্দের ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা, অল্প কথায় ইস্তাহার সেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল বলেই পরিবেশ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করা হয়নি।
অথচ এ রাজ্যে দূষণ যে ভোটের অন্যতম ‘ইস্যু’ বা বিষয় হতে পারে, অনেক পরিবেশকর্মী বিশ্লেষণ সহযোগে সেটা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, কলকাতায় বায়ুদূষণ মারাত্মক। গঙ্গাদূষণেও প্রথম সারিতে বাংলা। স্পঞ্জ আয়রনের কারখানার জন্য দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শ্রমিকেরা। আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের বিষাক্ত রাসায়নিকের দাপট বাড়ছে পানীয় জলে। দূষণের কোপে পড়ছে নদনদী, অরণ্য, প্রাণিকুলও। উৎসবের মরসুমে শব্দদূষণের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সাধারণ বাসিন্দারা। দূষণের ব্যাপারে নেতানেত্রীরা যে ব্যক্তিগত ভাবে উদাসীন, তা-ও নয়। যেমন আরএসপি-র মনোজবাবুই বলছেন, ‘‘দূষণের জন্য কলকাতায় শ্বাস নিতেই ভয় করে। শব্দদৈত্যের দাপটে পুলিশের দ্বারস্থও হয়েছি।’’
নেতানেত্রীরা যদি ব্যক্তিগত ভাবে সচেতনই হবেন, তা হলে পরিবেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক অসাড়তা কেন? ভোটের প্রচারে কেন হাতিয়ার করা হচ্ছে না পরিবেশের দুরবস্থাকে?
কোনও দলের নেতানেত্রীরাই এর সবিস্তার ব্যাখ্যায় যেতে রাজি নন। অথচ এই ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলিকে সচেতন করে দেওয়ার কাজ কেউ কেউ করেই চলেছেন নিয়মিত। যেমন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ভোটের বাদ্যি বাজতেই ইস্তাহার ও ভোটের প্রচারে পরিবেশ সংক্রান্ত দাবিদাওয়া তুলে ধরার আবেদন জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে চিঠি দিয়েছিলেন। পরিবেশ আইন বলবৎ করা, জলাভূমি রক্ষা, পরিবেশবান্ধব পাট ও চা শিল্প বাঁচানোর কথা বলেছিলেন।
ইস্তাহার দেখে বিশ্বজিৎবাবুর আক্ষেপ, ‘‘কেউই কথা রাখেনি!’’ শাসক দলের ইস্তাহার দেখে পরিবেশবিদেরা হতাশ। এক পরিবেশবিদ বলছেন, ‘‘মন্দারমণি, সাগরদ্বীপের মতো উপকূল এলাকার পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। উল্টে সাগরদ্বীপে ঢেউসাগর, রূপসাগর নামে পর্যটন কেন্দ্র গড়ার কথা বলা হয়েছে। যা কিনা বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’
রাজনীতির লড়াইয়ে পরিবেশকে অবহেলা করার ইতিহাস অবশ্য বেশ পুরনো। বাম আমলে বেশির ভাগ সময়ে মন্ত্রিসভায় পরিবেশ দফতরের দায়িত্ব পেতেন তাঁরাই, নিজেদের শিবিরের চোখেও যাঁরা ‘নড়বড়ে’ সদস্য। পরিবর্তনের জমানাতেও সেই ট্র্যাডিশন বদলায়নি। ‘‘মন্ত্রিসভায় পরিবেশমন্ত্রীর গুরুত্ব দেখে আক্ষেপ করতেন এক প্রাক্তন রাজ্যপালও,’’ বলেন পরিবেশ দফতরের এক কর্তা।
পরিবেশকর্মীরা কি এ বার সরাসরি রাজনীতিতে নামবেন?
‘গ্রিন পার্টি’ গড়া নিয়ে মাঝেমধ্যেই গুঞ্জন শোনা যায় পরিবেশকর্মীদের মধ্যে। কিন্তু সেই দল এখনও আলো দেখেনি। ‘‘গ্রিন পার্টি হবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আগামী দিনে পরিবেশকর্মীরা রাজনীতির লড়াইয়ে নামতেও পারেন,’’ সঙ্কল্পের আভাস বিশ্বজিৎবাবুর গলায়।