মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার পর। —ফাইল চিত্র
এর পর সেতু ভাঙলে আর ছাড় পাবেন না সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারেরা— মঙ্গলবার পূর্ত দফতরের বৈঠকে এমনই সতর্কবার্তা শোনালেন পূর্তসচিব অর্ণব রায়। একই সঙ্গে অবশ্য তাঁদের কাজ করানোর পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, পূর্ত দফতরের আমলাদের গড়িমসিতেই দরপত্র চূড়ান্ত করতে সাত মাস কাটে।মাঝেরহাট সেতুর অসুখ প্রায় দু’বছর আগে ধরা পড়লেও কেন সময়মতো তা সারানো হয়নি, এ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। তার পরে পাঁচ মাস কেটে গেলেও বরাত দিয়ে উঠতে পারেনি অর্থ দফতর। অন্য দিকে আমলাদের বক্তব্য, পূর্ত দফতরের ম্যানুয়াল অনুযায়ী সেতু-রাস্তার হালহকিকতের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারদের। ২০১৬ সালে খড়গপুর আইআইটি মাঝেরহাট সেতুর হাল দেখে বড় গাড়ি চলাচল বন্ধ করা এবং অন্য গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ডেড লোড’ কমাতে বলেছিল। তা ইঞ্জিনিয়াররা কেন করেননি, সেই প্রশ্ন তুলেছেন সচিবরা।
এই পরিস্থিতিতে এ দিন দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে বৈঠকে বসে সেতু, সড়ক এবং অন্যান্য প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন পূর্তসচিব। বৈঠকে ইঞ্জিনিয়ারদের কর্তব্য সম্পর্কে বিশ দফা নির্দেশিকা জারি করেছেন তিনি। তাতে বলা হয়েছে, অবিলম্বে পূর্ত দফতরের হাতে থাকা ১৪০০ সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যে সব সেতুর হাল খারাপ সেগুলি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মেরামত করতে হবে। গত ১০ বছর যে সব সেতুর সংস্কার হয়নি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে সেগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সাত দিন অন্তর কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। বকেয়া সব কাজ শেষ করতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। টেন্ডার ডাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং জোনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার। সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্যা হলে চিফ ইঞ্জিনিয়ার (পরিকল্পনা)-র মতামত নিতে হবে।
পূর্তসচিব জানিয়ে দিয়েছেন, প্রায় ভেঙে পড়া সেতুগুলির মেরামতের জন্য আগে টেন্ডার করার প্রয়োজন নেই। কাজ সেরে পরে এস্টিমেট জমা দিলেই চলবে। এই কাজ এখনই শুরু না হলে সব দায় সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারদের বলে জানিয়ে দেন পূর্তসচিব। ঊর্ধ্বতন কোনও আধিকারিক অধস্তনের প্রস্তাবকে গুরুত্ব না-দিলে সেই তথ্য মন্ত্রী অথবা সচিবকে জানাতে বলা হয়েছে এ দিনের বৈঠকে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনও কাজ জরুরি ভিত্তিতে করতে হলে লাল রঙের নতুন ফাইল খোলার কথা বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। আধিকারিকদের একটি অংশের ব্যাখ্যা, অর্থের অভাবে যাতে কাজ না আটকায়, তা নিশ্চিত করার জন্য ‘রেড ফাইল’ খুলতে
বলা হয়েছে।
ইঞ্জিনিয়াদের একাংশ অবশ্য এই নির্দেশিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, সেতুর স্বাস্থ্য বুঝতে ভরসা তো চোখের দেখা। কোথায় ফাটল ধরেছে, চাঙড় খসেছে, আগাছা জন্মেছে বা কংক্রিট ফেঁপেছে, তা খালি চোখে বোঝা যায়। কিন্তু ৩০-৪০ অথবা ৫০ বছর আগের সেতুতে কংক্রিট বা ইস্পাতের অবস্থা এখন কেমন, তা খালি চোখে বোঝা মুশকিল। তার জন্য প্রযুক্তি প্রয়োজন। সেই প্রযুক্তি যখন দফতরের নেই, তখন সব দায় ইঞ্জিনিয়ারদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। সেতু পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন ওই ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁদের আরও বক্তব্য, সেতু-সড়ক নির্মাণের যাবতীয় কৃতিত্ব তো মন্ত্রী-আমলারাই নেন। তা হলে বিপর্যয় হলে তার দায় শুধু ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে বর্তাবে কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বা পূর্তসচিব। নবান্ন সূত্র অবশ্য বলছে, পূর্তসচিবের নির্দেশ বহাল থাকবে বলেই জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসনের শীর্ষ মহল।
এ দিনের বৈঠকে পূর্তসচিব বলেছেন, শুধু সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেই হল না, যে সংস্থা কাজ করবে তাদের নির্দিষ্ট ভাবে বলে দিতে হবে করণীয় কী কী। তারা সেতুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে আশঙ্কার কথা জানালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংস্কারের কাজ করতে হবে। তাঁর নির্দেশিকায় সেতু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, অপ্রয়োজনীয় কংক্রিট বা পিচ চেঁচে ফেলে ‘ডেড লোড’ কমানো, সেতুর মাঝের নালাগুলি পরিষ্কার করা বা গাছ গজালে তা সমূলে তুলে ফেলার কথা বলা হয়েছে। এই সব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব একমাত্র এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের।
এক পূর্ত কর্তার কথায়, ‘‘যে সব কাজ করতে বলা হয়েছে, তা ইঞ্জিনিয়ারদের এমনিতেই করার কথা। লিখিত নির্দেশ দিয়ে সেই দায়িত্ব স্মরণ করাতে হচ্ছে, এটাই লজ্জার।’’